চেনা থাইল্যান্ড, অচেনা ভ্রমণ

চেনা থাইল্যান্ড, অচেনা ভ্রমণ

শতাব্দী দত্ত

মে, ২০১৪, ০০:০০:০০
eeeprint

প্রথম দিন
বিদেশ যাওয়ার ইচ্ছে বহু দিনের। পাসপোর্ট হাতে পাওয়ার পর তাই আর দেরি করিনি। গত নভেম্বরের এক রাতে বেঙ্গালুরু থেকে রওনা হলাম তাইল্যান্ড এর উদ্দেশে। বিমানে উঠেই ঘড়ির কাঁটা তাইল্যান্ডের সঙ্গে মিলিয়ে দেড় ঘণ্টা এগিয়ে নিলাম। প্রথম বারের বিদেশ যাত্রা, উত্তেজনা তাই একটু বেশিই
সকাল সওয়া টা নাগাদ  সুবর্ণভূমি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছলাম। অভিবাসন প্রক্রিয়া শেষে পাটায়াগামী বাসের টিকিট কাটলাম।  বাসে পাটায়া যেতে সময় লাগে ঘণ্টা দুয়েক
সন্ধের শোয়ে আলকাজার-এর  টিকিট কাটা ছিল। এখানে যাতায়াতের জন্য ভাট বাস ব্যবহার করাই ভাল। টুকটুকের থেকে একটু বড় মাপের হয় এই বাসযে যার গন্তব্যস্থলে পৌঁছে বেল বাজাও, টাকা দাওনেমে পড়
হোটেল থেকে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে থার্ড রোডের উপরের দোকানগুলোতে চোখ বোলানো গেল। পোশাক থেকে হরেক রকমের খাবারদাবার, ম্যাসাজ পার্লারসব নিয়ে এক জাঁকজমক বাজার ওয়াকিং স্ট্রিটের দিকে ছড়িয়ে পড়েছে। বিকেলের দিকে বাসে চেপে পৌঁছলাম আলকাজার থিয়েটারের সামনে। শো শুরু হওয়ার আগে শিল্পীদের সঙ্গে ছবি তোলা যায়। তবে ভাটের বিনিময়ে। নরম পানীয় এবং জলের বোতলের দাম টিকিটের ভেতরেই ধরা থাকে। দেড় ঘণ্টার এই শো আসলে ভারত, তাইল্যান্ড, চিন, জাপানকম্বোডিয়াকোরিয়া, আরববিভিন্ন দেশের গানের উপর ভিত্তি করে নৃত্যানুষ্ঠান






দ্বিতীয় দিন
দিনের সফরসূচিতে শুধু প্রবাল দ্বীপ। সকাল টা নাগাদ বাসে চেপে গেলাম বালি হাই ফেরিঘাটে। কো লারনে যাওয়ার ফেরিতে চড়ে নাবান পোর্টসেখান থেকে ফের বাসে চেপে তাওয়েন পোর্ট। এখানে তলায় কাচ লাগানো নৌকায় প্রবাল দেখতে গিয়ে বেশ হতাশ হলাম। এর পর বিচে কিছু ক্ষণ রঙিন ছাতার তলায় কাটিয়েস্পিড বোটে গেলাম কো সাকে। সমুদ্রের তলায় হেঁটে প্রবাল দেখা, মাছেদের খাবার খাওয়ানো, ছবি ভিডিও তোলাসব মিলিয়ে আধ ঘণ্টা বেশ ভালই কাটল

সুনামিতে অনেক কোরাল রিফ নষ্ট হয়ে গিয়েছে। কিন্তু প্রথম বার প্রবাল দ্বীপ দেখার রোমাঞ্চ ভোলার নয়। এর পর কো লারনে ফিরে গিয়ে খাওয়ার পালা। এখানকার সি-ফুড স্টলগুলিতে পাওয়া যায় কাঁকড়া, ঝিনুক, চিংড়ি, স্কুইডআরও অনেক রকমের সামুদ্রিক মাছ। খাওয়াদাওয়া সেরে পাটায়ার দিকে রওনা দিলাম

তৃতীয় দিন

পাটায়া থেকে ব্যাঙ্কক ফেরার আগেসাংচুয়ারি অব ট্রুথদেখে নেওয়ার পালা। সমুদ্রতীরের এই মন্দির উচ্চতায় প্রায় ১০০ মিটার এবং আয়তনে প্রায় ২১১৫ বর্গ মিটার। ১৯৮১ সালে তাই ব্যবসায়ী লেক ভিরিয়াপন্থের উদ্যোগে এই মন্দির নির্মাণের কাজ শুরু হয়। ২০২৫ সাল নাগাদ এর কাজ শেষ হবে। কাঠের উপর বিভিন্ন দেবদেবীর মূর্তিহিন্দু, বৌদ্ধ, চিন, কম্বোডিয়ার পৌরাণিক কাহিনির অনুপ্রেরণায় খোদিত। মহাভারতের যুদ্ধক্ষেত্রে বর্ণিত অর্জুনের উদ্দেশ্যে সারথি কৃষ্ণের বাণীও খোদিত আছে এখানে

চতুর্থ দিন

দিনের গন্তব্য আয়ুথায়া। দ্বিতীয় সিয়াম -এর এই রাজধানী ১৯৯১ সাল থেকে ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের মর্যাদাপ্রাপ্ত। হুয়ালাম্ফং স্টেশন থেকে ট্রেনে প্রায় আড়াই ঘণ্টা লাগে। নদী পার হয়ে টুকটুক নিয়ে দরাদরি শুরু। রফা হল ৫০০ ভাটে। সুখথায়া সাম্রাজ্যের পতনের পর ১৩৫০ সালে আয়ুথায়া সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তনের ইতিহাস রচিত হয়। ৪১৭ বছর ধরেতেত্রিশ জন রাজারসত্তরটি যুদ্ধের সাক্ষী বহন করছে আয়ুথায়া। তিন নদীর কোলে গড়ে ওঠা এই সাম্রাজ্য ভারত, চিন, মায়ানমারের কাছে হওয়ায়এক সময় এশিয়ার বিখ্যাত বাণিজ্যকেন্দ্রের স্বীকৃতি পেয়েছিল। প্রায় চারশো মন্দির একাধিক সোনায় মোড়া প্রাসাদের বিত্তের কাহিনি শেষ হয় ১৭৬৭ সালে বর্মীদের আক্রমণে। জ্বালিয়ে দেওয়া হয় এই শহরকে, ধ্বংস হয় অসংখ্য বুদ্ধমূর্তি, চেদি, প্রাং। চলে লুঠতরাজও

পঞ্চম দিন
পূর্ব পরিকল্পনা মতো সি ফ্রায়া ফেরিঘাটে পৌঁছলাম সকাল টা নাগাদ। এখান থেকে টুরিস্ট বোটে করে পৌঁছলাম চাও ফ্রায়া নদীর পূর্ব পাড়ের থা চাঙ ফেরিঘাটে, গ্র্যান্ড প্যালেসের কাছে। না ফ্রা লারন রোডের প্যালেসের প্রবেশমূল্য ৫০০ ভাট। এতেই ওয়াট ফ্রা কিউ ডুসিত প্যালেসের ভিমানমেক ম্যানসনের প্রবেশমূল্য ধরা থাকে। গরম থেকে রক্ষা পেতে রাজা পঞ্চম  রামার নির্দেশে সোনালি টিক কাঠের এই  ভিমানমেক ম্যানসন গড়ে ওঠে।
গ্র্যান্ড প্যালেসের মধ্যে হাতাওয়ালা জামা, ফুলপ্যান্টমোজা-সমেত চপ্পল পরা বাধ্যতামূলক। সিয়ামের রাজধানী থনবুরি থেকে ব্যাঙ্ককে  স্থানান্তরিত হওয়ার পর এই গ্র্যান্ড প্যালেস ১৭৮২ সালে তাই-ইউরোপিয়ান স্থাপত্যশৈলীতে তৈরি হয়। প্যালেসের মধ্যে একমাত্র পান্নার বৌদ্ধমন্দিরটি ছাড়া বাকি জায়গাগুলিতে সাধারণের প্রবেশ নিষিদ্ধ
প্যালেসের অদূরে শায়িত-বুদ্ধের মন্দিরওয়াট ফো প্রবেশমূল্য ১০০ ভাট। এখানে রয়েছে তেতাল্লিশ মিটার লম্বা পনেরো মিটার উচ্চতার শায়িত বুদ্ধমূর্তি
আমাদের পরবর্তী গন্তব্য ওয়াট অরুণ। তাই থা তিয়েন থেকে ফেরি করে পারে পৌঁছনো গেল মাত্র ভাটের বিনিময়ে। ঊনবিংশ শতাব্দীতে রাজা দ্বিতীয় রামার নির্দেশে হিন্দু দেবতা অরুণের উৎসর্গে বানানো হয় এই মন্দির। এর অসম্পূর্ণ কাজ শেষ করেন রাজা চতুর্থ রামা। ঝিনুক এবং ভাঙা পোর্সেলিন দিয়ে তৈরি অসংখ্য ফুলের মোটিফমন্দিরের গা-কে আরও  সুন্দর করেছে। মন্দিরের ওপর থেকে সোনালি বিকেলের  চাও ফ্রায়া দেখতে বেশ ভাল লাগে

ষষ্ট দিন

ডন মিয়াং বিমানবন্দর থেকে বিমানে তাইল্যান্ডের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলবর্তী দ্বীপ ফুকেটে যাচ্ছি। আন্দামান সাগরের উপর শ্বেতশুভ্র পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘের সারি। আরও খানিক পরে সারিবদ্ধ গাছের মাঝখানে নীল সবুজ সমুদ্র দেখেই বুঝলাম ফুকেট আমাদের নিরাশ করবে না। পাটং, কাটা, কামলা বিচে যাওয়ার বাস ফুকেট বিমানবন্দরের বাইরে থেকেই পাওয়া যায়

সপ্তম দিন
সকাল  সাতটা নাগাদ রিসেপশন থেকে ফোন এল কো ফি ফি যাওয়ার জন্য। কো মানে দ্বীপ। ফি ফি ডন ফি ফি লে এই দুই দ্বীপ নিয়ে হল কো ফি ফি। এর মধ্যে ফি ফি লে হল জনবসতিহীন। আও তন সাই এবং আও লো দালামএই দুটি দ্বীপ সরু এক ফালি ভূখণ্ড দিয়ে জুড়ে গিয়ে তৈরি হয়েছে ফি ফি ডন। ফি ফি ডনে হোটেল, বাজার সবই আছে। এখানেই আমাদের ক্রুজ গিয়ে থামবে মধ্যাহ্নভোজনের জন্য। সাড়ে আটটা নাগাদ আমরা গিয়ে বসলাম ক্রুজেচা, কফি, বিস্কুট বরাদ্দ ছিল। নীল সমুদ্রের বুক চিরে চলে যাওয়া প্রমোদ-তরী যেন ঢেলে দিয়ে যাচ্ছে দুধের মতো ফেনিল রাশি পঁয়তাল্লিশ কিলোমিটারের এই যাত্রাপথ সহযাত্রীদের সঙ্গে গল্পগুজব রসিকতায় বেশ ভালই কাটল। একে একে এল মায়া বে, বিদা আইল্যান্ড, লহ সামাহ বে,পিলাহ বে, ভাইকিং কেভ এল। এর মধ্যে পশ্চিম উপকুলের আও মায়াতেই অ্যালেক্স গারলান্ডের বিখ্যাত উপন্যাস অবলম্বনে তৈরিদ্য বিচছবির শ্যুটিং হয়েছিল

নীল সমুদ্র দেখতে দেখতে কখন যে সময় পেরিয়ে গেল বুঝতেই পারলাম না। ফি ফি ডনে পৌঁছাতেই আমরা তৈরি হয়ে নিলাম স্নরকেলিং-এর জন্য। প্রথমটায় বেশ ভয় ভয় করছিল। কিন্তু পরে বেশ মজা পেয়েছি

নবম দিন

ফুকেট থেকে ব্যাঙ্ককের ডন মিয়াং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নেমে শাটল বাসে সুবর্ণভূমিতে পৌঁছলাম। এখান থেকে এয়ারপোর্ট হাইস্পিড লিঙ্ক ধরে গেলাম হোটেল। সারা দিন বিশ্রাম নিয়ে সন্ধেয় হোটেলের চার পাশটা ঘুরলাম


দশম দিন
সকাল সাড়ে আটটা নাগাদ হোটেল থেকে বেরিয়ে গেলাম চাতুচাক বাজারে। বিচিত্র সম্ভারের এই মার্কেট উত্তর ব্যাঙ্ককের একটি দর্শনীয় স্থান। সাতসকালেই খাবার স্টলগুলিতে লোক উপচে পড়া ভিড়। এখানকার কোকোনাট আইসক্রিম ,স্পাইসি ক্র্যাব স্যালাডসোম-টামগ্রাসজেলি আইসক্রিম, ফিসবলস্টিকি ম্যাঙ্গো রাইসকোয়েলের ডিমসোমটামখাও প্যাড খুবই সুস্বাদু


Comments

Popular posts from this blog

আমাজান এর জঙ্গল----Amazon jungle

গ্রামের বাড়ি