জার্মানিতে ৪০ বছর: রাজনৈতিক আশ্রয় নাকি ছাত্র ভিসা?
আমার ছোটবেলার বন্ধু ফরহাদের একটা গুণ লক্ষ্য করে এসেছি। সে সবসময় বন্ধুবান্ধব প্রিয় মানুষ, আর দল বাধার একটা ঝোঁক আছে ওর মধ্যে।
এই ফ্রাঙ্কফুর্টে এসেও দেখলাম, ছয়মাসের মধ্যে ওর একটা ছোটখাটো দল হয়ে গেছে। তার পরিচিতরা প্রায়ই ওর ওখানে আসা-যাওয়া করত। এ কারণে আমাদের সুবিধা হল যে আমরা কারও কারও কাছ থেকে জার্মানিতে থাকার পদ্ধতি, কাজের পরিবেশ- এসবের ধারণা ঘরে বসেই পেতে শুরু করলাম।
মোটা দাগে সে সময় জার্মানিতে থাকার দু’টো পথ ছিল। একটি হচ্ছে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করা, আর আরেকরটি হচ্ছে ছাত্র হিসেবে থাকার আবেদন করা। প্রথম পথটি ছিল আপেক্ষিকভাবে সহজ আর দ্বিতীয়টি ছিল ঘোরানো।
সুবিধা-অসুবিধা স্বাভাবিকভাবে দুটো পথেই ছিল। যেমন- রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করলে কাজ পাওয়ার আগ পর্যন্ত সরকারের কাছ থেকে ঘর ভাড়া আর খাবার টাকা পাওয়া যায়। অন্যদিকে ছাত্র হলে সব খরচ নিজেকেই চালাতে হতো এবং একজন ছাত্র শুধু ছুটির সময় কাজের পারমিশন পেত।
জানতে পারলাম, আশ্রয় প্রার্থনা করে যারা আবেদন করবেন, তারা দেশের বাইরে তো নাই-ই, এমন কি অনুমতি ছাড়া জার্মানির অন্য শহরেও যেতে পারবেন না। নৈতিকতার কারণে নয়, তখন আমার কাছে বড় হয়ে দেখা দিল- দেশে বেড়াতে যাই বা না যাই, যাওয়ার পথটিও একদম বন্ধ হয়ে যাবে, সেটা কি করে হয়?
তাছাড়া আমি কাজ করার চেয়ে পড়াশোনাই বেশি পছন্দ করি। এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় মনে পড়ে গেল, আসার আগে আমার সেজো বোনের কথা। উনি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আই.ই.আর. বিভাগের সহকারী অধ্যাপক এবং ডক্টরেট করে এসেছিলেন আমেরিকা থেকে। তিনি বিদায় দেওয়ার সময় আমাকে প্রশ্ন করেছিলেন, “তুই যে জার্মানি যাবি, ওখানে গিয়ে করবি কী?”
কঠিন প্রশ্ন, আসলে আমি তো নিজেই জানি না যে কি করবো আর জার্মানি যেয়ে টিকতে পারব কিনা?
তিনি আমাকে বোঝালেন, “ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেছিস বলে বড় কিছু মনে করিস না।”
তিনি নিজের কথা বললেন, “ডক্টরেট করে এসে কী শিখেছি জানি না, তবে এটা ঠিক যে সূচিপত্র দেখা শিখেছি। সুতরাং যাচ্ছিস-ই যখন, পারলে পড়াশোনা করার চেষ্টা করিস।”
এই কথাগুলো সারাজীবনের জন্য মনের সিন্দুকে রয়ে গেল। তাই ছাত্র হওয়ার পেছনে তার কথাগুলো ওই সময় আমার কাছে ক্যাটালিজিটরের মত কাজ করেছে। নিজের সাথে নিজেই দু’দিন বোঝাপড়া করে সিদ্ধান্ত নিলাম, আমি ছাত্র হওয়ার পথে এগোবো।
দেশ থেকে বের হওয়ার পর এই ক’দিন বাড়ির মানুষের সাথে যোগাযোগ করা হয়নি। কারণ ১৯৭৭ সালে জার্মানি থেকে যোগাযোগ আজকের সস্তা মোবাইলের যুগের মত সহজ ছিল না। এখানে টেলিফোন সেল ছিল কিন্তু খরচ ছিল ওই পরিস্থিতিতে আমাদের কাছে অনেক বেশি। মিনিটে মনে হয় তিন মার্কের মত ছিল।
কি আর করা, অগত্যা চিঠি লেখা ছিল আমাদের একমাত্র উপায়। দেশে লিখলাম, আমি
ভাল মত পৌঁছেছি, বর্তমানে বন্ধুর বাসায় ভাল আছি। এর সাথে অবশ্য ইঙ্গিত দিয়ে গেলাম যে, এখানকার জীবন অনেক কঠিন এবং সামনে আছে দীর্ঘ বন্ধুর পথ। আর আমি এখানে থাকলে ছাত্র অবস্থায় থাকতে চাই এবং আমাকে সেই অর্থের যোগান নিজেকেই কাজ করে করতে হবে। কিন্তু আমি নতুন বলে আমাকে প্রথমে নতুন আবহাওয়া, ভাষা, থাকার জায়গা- এসবের সাথে কিছুটা হলেও খাপ-খাইয়ে নিতে হবে, তারপর অর্থ উপার্জন।
বাড়ির ভাই-বোনরা আমার পত্রের ভাষা বুঝে ফেলল। উত্তর পেলাম বেশ কিছুদিন পর, কারণ চিঠি একপ্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে যেতে লাগতো সপ্তাহেরও উপর। এদিকে আমি ছাত্র হওয়ার বিষয়ে আরও একটু তথ্য নেওয়ার চেষ্টা করতে থাকলাম।
তখন কিভাবে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করা যায়, সে বিষয়ে পরামর্শ আমাদের বন্ধুরাই দিতে পারবে। কিন্তু তখন বাংলাদেশি ছাত্র ফ্রাঙ্কফুর্টে ছিল হাতে গোণা কয়েকজন, তাই তাদের দেখা পাওয়া কঠিন ছিল। তবে এর মধ্যেই ফরহাদের এক পরিচিত ফ্রাঙ্কফুর্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন, তিনি ওখানে এসেছিলেন। আমি তাকে পেয়ে মোটামুটিভাবে বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করলাম, কিভাবে আমি এখানে স্টুডেন্ট ভিসার পেতে পারি।তিনি আমাকে বুঝিয়ে দিলেন, প্রথমে আবাসস্থলের রেজিস্ট্রেশন তো করাতেই হবে। তারপর লাগবে স্পন্সরের গ্যারান্টি কাগজ। তখন সুবিধা ছিল, দেশ থেকে এই কাগজ নিয়ে আসলেই হয়ে যেত। আর পরে তারা চেক করত না যে আমার দেশ থেকে সত্যি টাকা আসছে কিনা? সাথে লাগবে ভাষা কোর্সে ভর্তি হওয়ার সার্টিফিকেট আর তার থেকে গুরুত্বপূর্ণ ছিল, ভাষা শেখার পর আমি কোনও বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজে ভর্তি হওয়ার যোগ্যতা রাখি কি না? বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তার নিশ্চয়তার সার্টিফিকেট।দু’দিনের মধ্যেই আমাদের থাকার বিষয়ে তিনজনেরই সিদ্ধান্ত হয়ে গেল, কে কোনভাবে এগোবে। রশিদ ও সেলিম রাজনৈতিক আশ্রয়ের দিকে যাবে আর আমি ছাত্র ভিসার দিকে। এই দুই পদক্ষেপেরই সাধারণ কাজ হচ্ছে, আমাদের আবাসস্থলের রেজিস্ট্রেশন করতে হবে। বিষয়টি খুব ঝামেলার হয়ে যেত যদি না ফরহাদের সাথে ওর বাড়িওয়ালার ভাল সম্পর্ক না থাকতো।সেই বন্ধু ভাবাপন্ন জার্মান বাড়িওয়ালার সাথে পরবর্তীতে আমারও খুব সখ্যতা গড়ে উঠেছিল। বাড়িওয়ালার নাম ছিল এরনেস্ট লেরপ (Ernst Lerp)। প্রায় ৬০ বছরের কাছাকাছি এই ভদ্রলোক দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় হিটলারের নৌসেনা ছিলেন এবং সাবমেরিনে থেকে যুদ্ধ করেছেন। তিনি প্রায়ই ওখানে তার বাড়ি দেখার জন্য আসতেন।
দুই-একদিনের মধ্যেই ফরহাদ তার দেখা পেল। লেরপ ফরহাদকে বা এশিয়ান কাউকে দেখলে দুষ্টুমির হাসি হেসে বলতেন, মিস্টার কিরি কিরি।ঘরে আমাদের তিনজনকে দেখেই হেসে ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরেজিতে বললেন, “অ্যানাদার থ্রি কিরি কিরি।”
সেই বাড়িওয়ালার কথা আমার স্মৃতিচারণের মাঝে বার বার চলে আসবে। তখন তো আমরা তাই চাইছিলাম, বাড়িওয়ালা আমাদের সাথে মজা করুক। আর এর মধ্যে আমরা রেজিস্ট্রেশনের জন্য তার সইটা করিয়ে নেই। তার ব্যগেই থাকতো রেজিস্ট্রেশনের ফর্ম, সে তিনটা ফর্ম বের করে আমাদের নাম আর তার বাসার ঠিকানা লিখে সাইন করে দিল। আমরা তখন খুব খুশি, কারণ তেমন কোন পরিশ্রম বা টাকা খরচ না করেই আমাদের একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ হয়ে গেল।
Comments
Post a Comment