সবচেয়ে সুন্দর করুণ



এয়ারপোর্টে নেমে কোনো রকম বিব্রতকর প্রশ্ন ছাড়াই পাসপোর্টে এন্ট্রি সিল পেয়েও মন থেকে খুঁতখুঁত ভাবটা যাচ্ছিল না মাহমুদ জামানের। মনে হচ্ছিল, অজানা-অচেনা মানুষদের আমন্ত্রণে এ দেশে এলাম, অথচ এয়ারপোর্ট থেকে কোথায় যেতে হবে, সেটাই জানি না! আমন্ত্রণপত্রে এসবের কিছুই লেখা নেই, শুধু বলা আছে—এখানকার প্রয়োজনীয় সবকিছুর ব্যবস্থা তারাই করবেন। একটা আন্তর্জাতিক লেখক সম্মেলনে অতিথি হয়ে এসেছেন তিনি, যদিও আয়োজকদের সঙ্গে ব্যক্তিগত পরিচয় নেই তাঁর। এ অবশ্য নতুন নয়, এর আগেও অনেক দেশেই গিয়েছেন, বিভিন্ন সময়ে। এখন পর্যন্ত কোথাও কোনো ঝামেলায় পড়েননি, তবু বিদেশে এলেই তাঁর বুক কাঁপে, শঙ্কায় ভরে থাকে মন। এই যেমন এখন, এক নতুন শঙ্কা জাগছে মনে। এই দেশে, চীনে, প্রায় খুব কম লোকই ইংরেজি বোঝেন, বলার তো প্রশ্নই ওঠে না, বিপদে পড়লে তিনি করবেনটা কী, যেখানে যোগাযোগের ভাষাটাই অচেনা? এসব ভাবতে ভাবতেই ট্রলি ঠেলে বাইরে এসে দাঁড়ালেন তিনি। আর তখনই চোখে পড়ল, তাঁর নাম লেখা প্ল্যাকার্ড উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ছোটখাটো এক মিষ্টি তরুণী। শঙ্কা কেটে গেল নিমেষেই, হাত নাড়লেন মেয়েটিকে উদ্দেশ করে, হাসিমুখে এগিয়ে গেলেন তার কাছে। মেয়েটির ঠোঁটেও মিষ্টি হাসি। নিজের কাছে থাকা কাগজ থেকে তাঁর নাম মিলিয়ে নিয়ে সাদর স্বাগত সম্ভাষণ জানাল সে। সঙ্গে থাকা আরেক অভ্যর্থনাকারী এসে তাঁর হাত থেকে ট্রলিটি নিজের হাতে তুলে নিল। মনে মনে কৃতজ্ঞতাবোধ করলেন তিনি। এঁরা যে না বলেই সুন্দর ব্যবস্থা করে রেখেছেন, তাতে সন্দেহ রইল না।
গাড়িতে উঠে মেয়েটির নাম-পরিচয় জানা গেল। ইউনান ইউনিভার্সিটিতে ইংরেজি ভাষা নিয়ে পড়ছে সে, দায়িত্ব পেয়েছে মাহমুদ জামানের দোভাষী বা ইন্টারপ্রিটর হিসেবে। শুনে তিনি স্বস্তি পেলেন। বিদেশে এসে, যে দেশে ইংরেজি ভাষা প্রায় অচল, একজন ইন্টারপ্রিটর পাওয়া অনেক বড় ব্যাপার। মেয়েটির নাম—ওয়াঙ মিঙউয়ে। দু-তিনবার নামটি উচ্চারণ করেও ঠিক সুবিধা করতে পারলেন না মাহমুদ জামান। মেয়েটি তখন সদয় হলো। বলল, ‘ইচ্ছে করলে আপনি আমাকে ইংরেজি নামেও ডাকতে পারেন।’
‘ইংরেজি নাম? সেটা আবার কেমন ব্যাপার?’
‘আমাদের সবারই একটা করে ইংরেজি নাম থাকে। বিশেষ করে বিদেশি অতিথিদের কাছে আমরা ওই নামটিই বলি।’
‘ইন্টারেস্টিং! ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলো তো!’
‘যেমন মিঙউয়ে শব্দের অর্থ ব্রাইট মুন, মানে পূর্ণিমার চাঁদ, তাই আমার ইংরেজি নাম লুনা।’
‘বাহ্! দারুণ ব্যাপার তো! তা বিদেশিদেরও চায়নিজ নাম দেওয়া হয় নাকি?’
‘না, তা সব সময় হয় না। কিছু কিছু ক্ষেত্রে থাকে।’
‘যেমন?’
‘যেমন, আপনি বাংলাদেশ থেকে এসেছেন। এখানে বাংলাদেশকে বলা হয় মানজালা।’
‘মানজালা!’
‘হ্যাঁ।’
‘মন জ্বালা নয় তো?’
‘এই দুটো কি আলাদা শব্দ?’
‘হ্যাঁ, আলাদা। উচ্চারণে ততটা বোঝা যায় না, তবে বানানে বোঝা যায়।’
‘এই শব্দের কি কোনো বাংলা অর্থ আছে?’
‘মানজালার নেই। তবে মন জ্বালার আছে।’
‘কী?’
‘জ্বলন্ত হৃদয়। বার্নিং হার্ট!
‘আচ্ছা! তাই নাকি?’ বলতে বলতে উচ্ছল হাসিতে ভেঙে পড়ল মিঙউয়ে ওরফে লুনা।
হাসিখুশি-আলাপী মেয়েটিকে ভালো লেগে গেল তাঁর, কিন্তু আলাপ করতে ইচ্ছে করছে না এখন, চোখ চলে যাচ্ছে আশপাশের নয়নাভিরাম দৃশ্যাবলিতে। চীনের দক্ষিণ প্রান্তের প্রদেশ ইউনানের রাজধানী এই কুনমিং। পাহাড়ঘেরা মেঘমেদুর নীরব শহর, ছিমছাম সুন্দর, প্রশস্ত রাস্তা, গাড়ির সংখ্যা কম, লোকজনও তেমন দেখা যাচ্ছে না। মেঘগুলো এসে সবুজ পাহাড়ে লেপটে পড়ছে, যেন এখানে ঘুমানোর জন্যই দীর্ঘ পথ বেয়ে এসেছে ওরা। দ্রুত এগিয়ে চলছে গাড়ি, অথচ একটা হর্ন বাজছে না কোথাও। প্রথম দেখায় তাঁর মনে হলো, এই শহরের ভাষা হলো ‘নীরবতা’, যেমন ঢাকার ভাষা ‘আর্তনাদ’। সব শহরেরই তো এ রকম ভাষা থাকে!
তাঁকে চুপ করে থাকতে দেখেই কি না কে জানে, মেয়েটি জিজ্ঞেস করল, ‘কেমন লাগছে আমাদের শহর?’
উত্তরে তিনি শহরটির ভাষার কথা বললে সে অবাক হয়ে বলল, ‘ঠিক বুঝতে পারিনি। একটু বুঝিয়ে বলবেন?’
‘তুমি যখন কাউকে কমিউনিকেট করো, তখন কি শুধু শব্দ দিয়ে করো? চোখের ইশারায়, ঠোঁটের হাসি দিয়ে করো না?’
‘হ্যাঁ, করি তো!’
‘নীরবতা দিয়ে করো না?’
একটু ভাবল লুনা, তারপর বলল, ‘হ্যাঁ, তাও করি।’
‘এই শহরও তার নীরবতা দিয়ে মানুষের সঙ্গে কমিউনিকেট করে।’
হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল মেয়েটির মুখ, ‘কেউ কোনো দিন এমন করে বলেনি তো!’
বোঝা গেল, খুশি হয়েছে সে। কে-ইবা নিজের দেশের প্রশংসায় খুশি না হয়?
এয়ারপোর্ট থেকে খুব দূরের পথ নয়, আধা ঘণ্টার মধ্যেই হোটেলে পৌঁছাল গাড়ি। পাঁচ তারা হোটেল, যেমনটি তিনি ধারণা করেছিলেন। অবশ্য পাঁচ তারা বা তিন তারা নিয়ে তাঁর মাথাব্যথা নেই। চলনসই হলেই হলো। পৌঁছানোর আগেই লুনা জানিয়েছিল, ডিনারের পর বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আয়োজকদের একটা মিটিং আছে। হোটেলে চেক-ইন করে, দশ মিনিটের মধ্যে হাতমুখ ধুয়ে একটু ফ্রেশ হয়ে ডিনারের জন্য রেস্তোরাঁয় যেতে যেতে লুনা তাঁর পছন্দের খাবার সম্পর্কে জানতে চাইল। তিনি জানালেন, খাওয়াদাওয়া নিয়ে কোনো শুচিবাই নেই তাঁর, বিশেষভাবে পছন্দের কোনো খাবারও নেই, এসব নিয়ে দুশ্চিন্তা না করাই ভালো। লুনা তাতে কান দিল না। একটা খালি টেবিল খুঁজে তাঁকে বসিয়ে নিজে গিয়ে আগে মেনু দেখে এসে বলল, ‘ভাত আছে। মাছ আর মাংসের তরকারিও আছে। আশা করি আপনার অসুবিধা হবে না।’
‘কী করে বুঝলে, আমি ভাত খেতে চাই?’
‘আপনারা তো প্রতিদিন ভাত খান, ইন্টারনেট থেকে সেটা জেনে নিয়েছি।’
‘আচ্ছা! বেশ হোমওয়ার্ক করে রেখেছ তাহলে?’
‘না, বেশি করিনি। চলুন, খাবার নিয়ে আসি। বুফে। নাকি আমি এনে দেব?’
‘আরে না। চলো, নিয়ে আসি।’
মাহমুদ জামান সব সময়ই স্বল্পাহারী। কিন্তু লুনার তো তা জানার কথা নয়, তাঁকে অল্প খেতে দেখে—‘আর কী লাগবে, ফল খাবেন কি না, চা খাবেন না কফি, এক গ্লাস দুধ এনে দেব?’—এসব বলতে বলতে ব্যতিব্যস্ত করে তুলল তাঁকে। তাঁর ভালোই লাগছিল, এতখানি যত্ন তিনি আশা করেননি।
খাওয়া শেষে মিটিং। সব দেশের প্রতিনিধিরা এসেছেন আগেই। আয়োজকেরাও। তিনিই কেবল ফ্লাইট শিডিউলের কারণে দেরিতে পৌঁছেছেন। তিনি যেতেই সবাই উঠে দাঁড়ালেন, পারস্পরিক পরিচয় বিনিময় হলো। তারপর আয়োজকদের পক্ষ থেকে ব্রিফিং। যেমনটি হয় আর কি! এই কনফারেন্সের উদ্দেশ্য, আলোচ্যসূচি, আগামী কয়েক দিনের কর্মসূচি, স্বাগত জানিয়ে সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা ইত্যাদি। কনফারেন্স-সংক্রান্ত যাবতীয় কাগজপত্রও বুঝিয়ে দেওয়া হলো সবাইকে।
লুনা সঙ্গেই ছিল, মিটিং শেষেও সে এল সঙ্গে। রুম পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে, চমৎকার একটা ঘুমের জন্য শুভকামনা জানিয়ে, কাল সকালের সূচিটা আবার মনে করিয়ে দিয়ে, বিদায় সম্ভাষণ জানিয়ে চলে গেল সে।
সারা দিনের ধকল শেষে এবার একটু বিশ্রাম মিলল। কিছুক্ষণ গা এলিয়ে সোফায় বসে রইলেন মাহমুদ জামান, তারপর উঠে গিয়ে দীর্ঘক্ষণ ধরে শাওয়ার নিলেন। ঝরঝরে সতেজ লাগল নিজেকে, ভ্রমণের ক্লান্তি মুছে গেছে শরীর ও মন থেকে। মনজুড়ে একটা স্বস্তিদায়ক প্রশান্তি—অনেক দিন পর এই অনুভূতির সঙ্গে দেখা হলো তাঁর। যদিও এই প্রশান্তিও তাঁকে ভালো একটা ঘুম উপহার দিতে ব্যর্থ হলো। নানা রকম দুঃস্বপ্ন দেখতে দেখতে, ঘুম ও জাগরণের দোলাচলে দুলতে দুলতে—যেমনটি প্রতিরাতেই হয় নিজের বাসায়ও—তাঁর ঘুম ভাঙল ভোর পাঁচটায়। আড়মোড়া ভেঙে দরজা খুলে ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়াতেই টের পেলেন, খুব আরামদায়ক শরীর জুড়ানো এক হাওয়া বয়ে যাচ্ছে। ভোর যেমনটি হয় সাধারণত, তার চেয়ে আজকেরটি যেন অনেক বেশি শুভ্র-সুন্দর-নির্জন। এ এমন এক শহর, যেখানে সারা বছরই তাপমাত্রা থাকে ১৫ থেকে ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে। গ্রীষ্মকালেও তাই হেমন্তের মায়া জড়ানো বাতাস। বুক ভরে নিশ্বাস নিলেন তিনি। মনে হলো, অনেক দিন পর যেন এক বিভীষিকাময় আতঙ্ক আর শঙ্কার দুঃসহ যন্ত্রণা থেকে মুক্তি মিলেছে তাঁর। কয়েক বছর ধরে অসহনীয় নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন তিনি। ক্রমাগত হত্যার হুমকি, জীবনকে ক্রমেই গুটিয়ে এনে একটা ঘরের মধ্যে বন্দী করে ফেলা, অচেনা কারও সঙ্গে কথা বলতে সন্দেহ-সংকোচ হওয়া, ইচ্ছেমতো কোথাও যেতে না পারা—এসব এখন জীবনের প্রধান অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে। সাম্প্রতিক সময়ে সেই নিরাপত্তাহীনতা আরও বেড়েছে। একের পর এক খুন হয়ে যাচ্ছেন তরুণতর লেখকেরা। প্রকাশ্য রাস্তায়, বাসার সামনের গলিতে, এমনকি ঘরের মধ্যেও। খুনিরা কেবল হুমকি দিয়েই বসে থাকছে না, যেখানে-সেখানে খুন করছে, অথচ সরকার নির্বিকার। লেখালেখি করার ‘অপরাধে’ কী অবমাননাকর, কী অপমানজনক পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছে তাঁর জন্য, তাঁদের জন্য, নিজ দেশে!
ঘড়িতে অ্যালার্ম দিয়ে রেখেছিলেন মাহমুদ জামান, নইলে বোধ হয় বুঝতেই পারতেন না ঘণ্টা খানেক ধরে ব্যালকনিতেই দাঁড়িয়ে আছেন। গোসল করে রেডি হয়ে বাইরে বেরোবেন, তার আগেই দরজায় টোকা। খুলে দেখলেন, হাসিমুখে লুনা দাঁড়িয়ে। সকালে উঠে এ রকম একটা হাসিমুখ দেখলেও মনটা ভালো হয়ে যায়। সম্ভাষণ জানিয়ে লুনা জানাল, তাঁকেই নিতে এসেছে সে। তিনি একাই যেতে পারতেন, তবু এই মনোযোগটুকু ভালো লাগল। মেয়েটার ভেতরে বোধ হয় যত্ন নেওয়ার একটা সহজাত প্রবণতা আছে, সেটা নাশতার টেবিলেও বোঝা গেল। এটা-সেটা তুলে দেওয়া, কোনটা খেতে ভালো লাগছে, কোনটা খারাপ লাগছে, দুধ এনে দেবে কি না, ফল খাবেন কি না, চা পছন্দ না কফি—কতকিছু যে জানার আগ্রহ তার! তিনি যতই বলেন, ‘আমার খাওয়াদাওয়া নিয়ে অত ভেবো না’, সে ততই চিন্তিত হয়ে পড়ে। লুনার ধারণা, তিনি ঠিকমতো খাচ্ছেন না, এভাবে চললে কয়েক দিনেই তাঁর শরীর ভেঙে পড়বে!


দুই.
মূল কনফারেন্স হলো পরপর তিন দিন। তাঁকে বক্তৃতা দিতে হলো প্রতিদিনই, আলোচনা করতে হলো নানা বিষয়ে। বাংলাদেশের মানুষের সংগ্রামমুখর জীবন আর তাঁদের উঠে দাঁড়ানোর গল্প; বাঙালি ও বাংলাদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য আর সংস্কৃতি; গ্রামের মানুষের বর্ণিল সাংস্কৃতিক জীবনের কথা, তাদের গান, গাথা, যাত্রাপালার কথা বললেন তিনি। হাজার খানেক বিদেশি অতিথির সামনে দাঁড়িয়ে এসব কথা বলতে বলতে তাঁর মনে হলো, এ যেন এক অলৌকিক গল্প! যে দেশের মানুষ এত যুদ্ধ করে বেঁচে থাকে, তাদের জীবনে এত গান এত গল্প আসে কোত্থেকে? তিনি কথার জাদুকর, হয়তো তাঁর কথাগুলো অন্যদের কাছেও অলৌকিক মনে হয়েছিল, ফলে অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি সবার প্রিয় হয়ে উঠলেন। সেটা বোঝা গেল অন্যদের আচরণ দেখেই। একা হওয়ার সুযোগই পাচ্ছিলেন না তিনি, কেউ না কেউ এসে আলাপ করছিল, সাংবাদিকেরা ভিড় করছিলেন সাক্ষাৎকারের জন্য ইত্যাদি।
মূল অনুষ্ঠান শেষে শুরু হলো সপ্তাহব্যাপী ভ্রমণ। আয়োজকেরা এই দেশের রূপবৈচিত্র্য আর জনগণের জীবনযাপন ও সংস্কৃতির সঙ্গে অতিথিদের পরিচয় করিয়ে দিতে চাইছিলেন। রাজধানী থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যন্ত একটানা ভ্রমণ, প্রতিদিনই কোনো না কোনো আদিবাসী গোষ্ঠীর আয়োজনে লাঞ্চ ও ডিনার, হরেক রকমের খাবার, উষ্ণ অভ্যর্থনা, আন্তরিক আতিথেয়তা, আর সন্ধ্যায় তাদের পরিবেশনায় বর্ণিল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। যেন আনন্দের এক অবিরাম হিল্লোল বইছে চারপাশে।
এক সন্ধ্যায় আদিবাসীদের এক গ্রামে অদ্ভুত এক অভিজ্ঞতা হলো তাঁর। লুনা দুজন বুড়োমতো লোককে দেখিয়ে বলল, ওঁরা আপনাকে একটু ছুঁয়ে দেখতে চান! মাহমুদ জামান হাসিমুখে এগিয়ে গিয়ে তাঁদের সঙ্গে করমর্দন করলেন, কিন্তু তাঁরা দুজনেই তাঁর হাতটি ধরেই রইলেন! কী যেন বলছেন, বুঝতে না পেরেও মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিলেন তিনি, আর তাঁরা মাথা নামিয়ে গভীর শ্রদ্ধায় তাঁর হাতে চুম্বন করলেন। যখন মাথা তুললেন, তিনি দেখলেন, তাঁদের চোখে জল! বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে গেলেন তিনি, লুনাকে জিজ্ঞেস করে ব্যাপারটা বুঝতে চাইলেন। সে জানাল, এঁরা শুনেছেন, বাংলাদেশ হলো পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর দেশ, আর ওই দেশের মানুষেরা পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো মানুষ। সেই দেশ থেকে একজন লেখক এসে তাঁদের সঙ্গে সময় কাটিয়েছেন, কথা বলেছেন, স্পর্শ করার অনুমতি দিয়েছেন, লেখকেরা তো ঈশ্বরের মতো, তাঁদের তাই মনে হচ্ছে, তাঁরা আজ, জীবনের এই শেষ প্রান্তে এসে ঈশ্বরের কল্যাণস্পর্শ পেলেন! শুনে মাহমুদ জামান গভীর আবেগে আলিঙ্গন করলেন তাঁদের। তাঁরা অশ্রুজলে ভাসলেন আবার, বিদায় দেওয়ার সময় লাইন ধরে দাঁড়িয়ে হাত জোড় করে মাথা নুইয়ে অভিবাদন জানালেন, তখনো তাঁদের চোখ অশ্রুসজলই হয়ে রইল। যেন এক অপরূপ রূপকথার রাজ্যে এসে পড়েছেন তিনি, যেন এটা জীবনানন্দের সেই সবচেয়ে সুন্দর করুণ স্থান! মনে হলো, এঁরা তাঁকে মায়ায় জড়িয়ে ফেলছেন। মনে হলো, বিশ্বজুড়ে—দেশকালের সীমানা পেরিয়ে মানবজাতির একটিই মাতৃভাষা—তার নাম ‘মায়া’।
তিন.
তিনি বেশ উপভোগ করছিলেন পুরো ভ্রমণটি। মনে হচ্ছিল, এত নির্ভার, দুশ্চিন্তাহীন, আনন্দময় সময় শৈশবের পর আর আসেনি তাঁর জীবনে। কিন্তু ফেরার সময় যে হয়ে এল! দুদিন পরই আবার ফিরে যেতে হবে সেই আতঙ্কের জীবনে, ভাবতেই বুকের ভেতর মুচড়ে উঠছে। এর মধ্যেই ঘটল আরেক ঘটনা। রাতে কেবলই ডিনার সেরে রুমে ফিরেছেন, তখনই ফোন বেজে উঠল। ওপাশ থেকে লুনা জানাল, ‘একজন সরকারি কর্মকর্তা লবিতে অপেক্ষা করছেন, আপনার সঙ্গে দেখা করতে চান। আপনি অনুমতি দিলে নিয়ে আসব।’
অনুমতি না দেওয়ার কোনো কারণ নেই, তবে তিনি অবাক হলেন। একটু আগেও লুনা সঙ্গে ছিল, তখন তো কিছু বলল না! রুমে ফিরতে না ফিরতেই ফোন! ব্যাপার কী?
পাঁচ মিনিটের মধ্যেই তিনি এসে এই গভীর রাতে তাঁকে ডিস্টার্ব করার জন্য দুঃখ প্রকাশ ও ক্ষমাপ্রার্থনা করে নানা সৌজন্যমূলক আলাপ জুড়ে দিলেন। মাহমুদ জামানের মনের ভেতরটা উসখুস করছিল। এই দুই সপ্তাহে অনেক উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তার সঙ্গে তাঁর দেখা হয়েছে, আলাপ হয়েছে, কিন্তু এভাবে কেউ চুপিসারে কথা বলতে আসেননি। ব্যাপারটা কী? ভদ্রলোক অবশ্য আসল কথা পাড়তে বেশি সময় নিলেন না। বললেন, ‘প্রিয় লেখক, আমাদের দেশের লেখকবৃন্দ এবং সরকার আপনাদের দেশের লেখকদের নিরাপত্তাহীনতার বিষয়ে সচেতন ও সজাগ রয়েছেন। আপনি নিজেও যে সেই ঝুঁকির মধ্যে আছেন, সেটা আমরা আন্দাজ করতে পেরেছি। আমি আমাদের সরকারের পক্ষ থেকে আমাদের উদ্বেগ জানাতে এসেছি এবং একটা অনুরোধও নিয়ে এসেছি। আপনি যদি অনুগ্রহ করে আমাদের দেশে কিছুদিন থাকতে চান, মানে যত দিন আপনার ইচ্ছা, আমরা অত্যন্ত আনন্দিত হব, ধন্য বোধ করব।’
মাহমুদ জামান অবাক হলেন না। বাংলাদেশের লেখকেরা যে এক অবর্ণনীয় নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন, এটা আর বিশ্বের কাছে গোপন নেই। একেকজন করে ব্লগার খুন হচ্ছেন আর সারা পৃথিবীর প্রধান সংবাদমাধ্যমগুলো সেই খবর গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করছে। নানা দেশ থেকে লেখকেরা ইতিমধ্যে বিবৃতি দিয়ে উদ্বেগ ও নিন্দা জানিয়েছেন, সরকারের কাছে খুনের বিচার দাবি করেছেন, লেখকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জোর দাবি করেছেন। এসব তো আর চাপা থাকার বিষয় নয়।
মাহমুদ জামান মৃদু হেসে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানালেন এবং বললেন, তাঁর দেশ ত্যাগ করার কোনো পরিকল্পনা নেই। ভদ্রলোক স্পষ্টতই অবাক হলেন। কিন্তু মাহমুদ জামান কারণটি ব্যাখ্যা করলেন না। দেশের দুঃসময়ে, কোটি কোটি মানুষকে নিরাপত্তাহীন রেখে নিজে নিরাপদ জীবনের সন্ধানে ভিন্ন দেশে আশ্রয় নেওয়া তো কোনো লেখককে মানায় না!
ভদ্রলোকের সঙ্গে পুরো আলাপটি হয়েছে লুনার মাধ্যমে, সে-ই দুজনের কথা অনুবাদ করে শুনিয়েছে দুজনকে, আর ধীরে ধীরে তার মুখ থেকে হাসি মুছে গিয়ে সেখানে শঙ্কা আর বিহ্বলতা জেগে উঠেছে। ছোট্ট একটা মেয়ে, জীবনের জটিলতা এখনো তাকে স্পর্শ করেনি, একজন লেখককে কীভাবে মেরে ফেলা যায়, এটা হয়তো তার মাথাতেই ঢুকছে না। মাহমুদ জামানও যে এ রকম এক ভয়ংকর ঝুঁকিতে আছেন, সেটাও সে কল্পনা করতে পারেনি। ওর সামনে এসব কথা না হলেই ভালো হতো।
ফিরে যাওয়ার সময় ভদ্রলোক এই দেশে আসার জন্য মাহমুদ জামানকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানালেন, শুভকামনা জানালেন, আবার চীন ভ্রমণের আমন্ত্রণও দিলেন, কিন্তু লুনা একটি কথাও বলল না, এমনকি প্রতিদিনের মতো বিদায় সম্ভাষণও জানাল না। সকালে নাশতার জন্য ডাকতেও এল না লুনা, যেমনটি এসেছে প্রতিদিনই। সেদিন কোনো কাজ নেই, একা একা শহরটা ঘুরে দেখবেন বলে যখন বাইরে বেরোচ্ছেন মাহমুদ জামান, তখন লুনার দেখা পাওয়া গেল। সে-ও সঙ্গে যাবে। তিনি বারবার না করলেন, কিন্তু সে ছাড়বেই না। তার মুখে হাসি নেই, গম্ভীর মুখে বলছে, ‘না, আপনাকে একা যেতে দেব না, আপনি হারিয়ে যাবেন।’ যেন তিনি একটা বাচ্চা ছেলে, এমনই ভঙ্গি কথার মধ্যে! অগত্যা তাকে নিয়েই বেরোতে হলো। প্রতিদিন মেয়েটা হেসে হেসে গল্প করে, আজ একবারে চুপচাপ। মেয়েটা এ কদিন তাঁকে একবারে আগলে রেখেছিল। রোদ লাগবে বলে মাথায় হ্যাট পরিয়ে দিয়েছে, গ্রামের বৃষ্টিভেজা পথে হাঁটতে গিয়ে পিছলে যেতে পারেন, সে জন্য নিজেই আগে আগে হেঁটে পথ দেখিয়ে নিয়ে গেছে, তিনি ঝাল খেতে পছন্দ করেন জেনে প্রতি বেলাতেই স্পাইসি খাবারগুলো তুলে দিয়েছে পাতে, কাঁচা মরিচ জোগাড় করে এনেছে, এমনকি একদিন ধনেপাতা শখ করে খেয়েছিলেন বলে সেটারও ব্যবস্থা করেছে নিয়মিত। কখন কী লাগবে, কোনো অসুবিধা হচ্ছে কি না, রাতে ভালো ঘুম হচ্ছে কি না, রাতে খিদে পায় কি না—কত দিকে যে খেয়াল তার! ঘুমানোর সময়টুকু ছাড়া একমুহূর্তও কাছ-ছাড়া হয়নি সে। অথচ আজ কথাই বলছে না। লাঞ্চের সময় তিনি দেখলেন, লুনা কিছু খাচ্ছেও না, সম্ভবত সকালে নাশতাও করেনি, মুখটা শুকনো হয়ে আছে। অনেক অনুরোধেও কিছু খেলো না সে। কিন্তু যত্নের ত্রুটি নেই, পাশে বসে এটা-সেটা তুলে দিচ্ছে আগের মতোই। এত মায়া মেয়েটার মধ্যে, সেই ‘সবচেয়ে সুন্দর করুণ’ মায়া। কাল চলে যাবেন, হয়তো সে জন্যই, কথায় কথায় তিনি একটা ভুল করে বসলেন এবার। বললেন, ‘তোমার যত্নের ধরনটি ঠিক আমার মায়ের মতো। মা চলে যাওয়ার পর কেউ এমন করে আমার যত্ন করেনি। তোমার সঙ্গে হয়তো আর কোনো দিন আমার দেখা হবে না, কিন্তু জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তোমার কথা মনে রাখব আমি।’
লুনা চুপ করে শুনল, একটু হাসলও না, একবার ভদ্রতা করে ধন্যবাদও দিল না।
কথাটা বলে যে ভুল করেছেন, সেটি বুঝলেন পরদিন বিদায়ের সময়, এয়ারপোর্টে। সব ফর্মালিটি লুনাই সারল, তারপর যখন বিদায় সম্ভাষণ জানালেন তিনি, তখন হঠাৎ ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল মেয়েটি। এই কান্নার জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিলেন না মাহমুদ জামান। কিছুক্ষণ বিমূঢ় দাঁড়িয়ে থেকে হাত বাড়িয়ে তাকে কাছে টেনে নিলেন, মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন, ‘বিদায়ের সময় এভাবে কাঁদতে হয় না।’
লুনা ফুঁপিয়ে উঠে বলল, ‘আপনি কেন বললেন, আপনার সঙ্গে আমার আর দেখা হবে না? আপনি কি কোনো দিন আর আসবেন না? আপনি না এলেও তো আমি যাব বাংলাদেশে, আপনাকে দেখতে যাব।’
‘নিশ্চয়ই যাবে, অবশ্যই যাবে।’
‘বলুন, আবার দেখা হবে।’
তিনি চুপ করে রইলেন। তার কষ্ট লাগছে। মানুষ মায়ায় বাঁচে, মায়ার জন্য বাঁচে। একজন মানুষ কারণে-অকারণে চেনা-অচেনা অন্য আরেক মানুষের সঙ্গে মায়ায় জড়ায়। লুনাও জড়িয়ে পড়েছে হয়তো। কিন্তু কী করে বলবেন তিনি, যে আবার দেখা হবে? যদি না হয়? যদি হঠাৎ মৃত্যু এসে হানা দেয় তাঁর দরজায়? নিজের দেশে যে এখন স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি নেই, সে কথা তিনি বলেন কী করে? প্রতিশ্রুতি না দিয়ে, মাথায় হাত বুলিয়ে, কপালে চুমু খেয়ে, বললেন, ‘ভালো থেকো। যদি আরেকটা জীবন পাই, আমি তোমার সন্তান হয়ে জন্মাব।’
তারপর হনহন করে হেঁটে ঢুকে গেলেন ইমিগ্রেশনের ভেতরে, দৃষ্টিসীমার বাইরে। পেছন ফিরে তাকালে হয়তো দেখতেন, লুনা তখনো এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তাঁর চলে যাওয়া পথের দিকে, আর তার চোখে তখনো বইছে জলের ধারা।

Comments

Popular posts from this blog

আমাজান এর জঙ্গল----Amazon jungle

গ্রামের বাড়ি