ভাটির পুরুষ-কথা


২০০৫ সালের ৮ জুলাই। দিরাই বাজার থেকে ভাড়া করে নেওয়া নাইয়রি নৌকাটি নিয়ে চলে আসি উজানধল গ্রামে। শাহ আবদুল করিমের বাড়িতে ঢুকেই মন খারাপ। আবদুল করিমের শরীর খারাপ যাচ্ছে কিছুদিন ধরে। একদম হাঁটাচলা করতে পারছেন না, কারও সঙ্গে কথাও বলছেন না।
শাহ আবদুল করিমের স্ত্রী ‘সরলা’কে নিয়ে কৌতূহলের শেষ নেই। ৪০ বছরের দাম্পত্য জীবন ছিল করিমের সঙ্গে তাঁর। শাহ করিম সরলাকে নিয়ে লিখেছেন অনেকগুলো গানও। নিজের বসতভিটায় তাঁর জন্য বানিয়েছেন ‘শাহ করিম জাহানের সরলামহল’ কবরখানি। ২০০৩ থেকে ২০০৯ সালের ১২ সেপ্টেম্বর তাঁর মৃত্যুদিন পর্যন্ত নানাভাবে তাঁর কাছাকাছি থেকেও এই ‘সরলা’ আমার কাছে এক রহস্যময়ী নারী হিসেবেই থেকে যান।
বারান্দায় বেশ কজন এসে ভিড়েছেন। ভাবলাম, এ অবসরে ‘সরলা রহস্য’ উদ্ঘাটনের চেষ্টা করি। শাহ আবদুল করিমের ছেলে শাহ নুর জালাল বাবুলকে বসালাম ক্যামেরার সামনে। শুরু হয় কথাবার্তা।
‘আপনার মা সরলার সঙ্গে আপনার বাবার বিয়ে হয়েছে কত বছর বয়সে?’
‘বাবার পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে, ১৯৫০ সালে তাঁর বিয়ে হয়। তাঁর বিয়ের ষোলো বছর পর আমার জন্ম হয়েছে। মা মারা যান ১৯৯০ সালে।’


‘এর আগে আপনার বাবা একটা বিয়ে করেছিলেন। এটা সম্পর্কে কিছু বলুন।’
‘সেটা বলতে পারব না।’
বারান্দায় বসে আছেন সরলার ভাই আফতাব আলী। তিনি বললেন, ‘আমার বোনের সঙ্গে বিয়ের সময় আমরা জানতাম না, পরে শুনেছি তাঁর আরেকটা বিয়ে হয়েছিল। ওই মহিলার ডাকনাম ছিল বৈশাখী এবং আসল নাম আফতাবুন নেসা।’
নুর জালাল প্রথমে তাঁর বাবার প্রথম বিয়ের বিষয়টি একেবারেই উড়িয়ে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, বিষয়টা তিনি জানেন না। কিন্তু মামার কথা শুনে এখন আলোচনায় যোগ দিয়েছেন। বললেন, দিরাইর কাছে ভাটি এলাকায় রন্নারচর নামে গ্রামের মমজান নামের এক নারীকে তাঁর বাবা বিয়ে করেছিলেন, কিন্তু ওই বিয়ে টেকেনি।
মমজান যদি তৃতীয় কোনো নারী না হয়ে থাকেন, তাহলে তাঁর প্রথম স্ত্রীই হবেন তিনি। সেই নারী বৈশাখ মাসে জন্মেছিলেন বলেই তাঁর নাম ছিল বৈশাখী এবং তার পোশাকি নাম হয়তো আফতাবুন নেসাই ছিল, অথবা এই নামটি করিম সাহেব নিজেই রেখেছেন। দুই মাস এই নারী তাঁর ঘরে ছিলেন, কিন্তু তিনি খোরপোশ দিতে পারতেন না। বিয়ে করার পর তিনি বউকে অসহায়ভাবে ফেলে রেখে চলে যান গানের আসরে। যখন ফেরত এলেন, দেখেন বউ তাঁর ঘরে নেই। আত্মীয়স্বজন মিলে সেই বউকে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে এবং করিম সাহেবকে দিয়ে প্রায় জোর করে ছাড়িয়েও দিয়েছে। এই নারীর স্মৃতিকথা ভুলতে না পেরে ‘আফতাব সংগীত’ নামে প্রেমসংগীত লিখেছিলেন তিনি। এর বেশ কয়েক বছর পর বিয়ে করেন নুর জালালের মাকে। তবে কি নুর জালালের মায়ের নাম আফতাবুন নেসা নয়?
দুই বছর আগে তাঁর বাড়িতে প্রথমবার এসে যে চারখানা বই (কালনীর ঢেউকালনীর কূলেধল মেলাগণসঙ্গীত) নিয়ে গিয়েছিলাম, তার প্রথম দুটির পেছনের প্রচ্ছদে শাহ আবদুল করিমের পাসপোর্ট সাইজের ছবির নিচে তাঁর যে পরিচিতি লেখা, সেখানে পারিবারিক পরিচয়ের জায়গায় লেখা আছে, ‘স্ত্রী আফতাবুন নেসা ওরফে সরলা, এক পুত্র—নুর জালাল।’
ঠিক এই বারান্দায় কয়েক মাস আগে বসেছিলাম এই আলোচনায়। বাউল করিমের দুই অতিঘনিষ্ঠ সাগরেদ রুহী ঠাকুর আর রণেশ ঠাকুরের বড় ভাই রবীন্দ্র ঠাকুর চক্রবর্তী ছিলেন এখানে। রবীন্দ্র ঠাকুর স্পষ্টই বলেছিলেন, আবদুল করিমের বয়স যখন পঁচিশ-ত্রিশ বছর, তখন দিরাইর চন্দ্রীপুর গ্রামের এক নারীকে বিয়ে করেন, তাঁর নাম ছিল আফতাব। সেই নারীকে এ বাড়িতে আনা হয়নি এবং বিয়েটা কেমন করে হলো, সেটাও তিনি জানেন না। পরবর্তী সময়ে করিম সাহেবের মুর্শিদ মৌলা বক্স মুনসী তাঁকে বিয়ে দেন দিরাইর খাসামরা গ্রামের এক কিশোরীর সঙ্গে, সেই নারীই নুর জালালের মা।
৩ অক্টোবর, ২০০৩ শাহ আবদুল করিম এ ঘরে বসেই তাঁর নিজের বিয়ে সম্পর্কে আমাকে বলেছিলেন, অন্য কথা—তাঁর এক নারীভক্ত ছিলেন। এই নারী তাঁকে বাবা ডাকতেন। তো সেই নারীর পাশেই ছিল আফতাবুন নেসার ঘর। আফতাবুন নেসার বাবা-মা নেহাত গরিব মানুষ। করিম সাহেবও গরিব। কিন্তু করিম সাহেবের পাতানো মেয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, যে করেই হোক আফতাবুন নেসাকে তিনি তাঁর ‘মা’ বানাবেন। সে জন্যই একদিন তিনি আর মুর্শিদ মৌলা বক্স তাঁর বাবাকে ডেকে আনলেন এবং তাৎক্ষণিকভাবে বিয়ে পড়ালেন। করিম সাহেবের ভাষায়, ‘বৈশাখ মাসে জন্ম ছিল বলে তার নাম ছিল বৈশাখী, আমি নাম দিলাম সরলা। সরলা অতি বুদ্ধিমতী, সহজ-সরল মানুষ...।’
শাহ করিম তাঁর ঘরের পূর্ব পাশের ভিটায় কবর দিয়েছেন সরলার। দিনে অন্তত একবার এই ঘরে তিনি প্রবেশ করেন, ঝাড়ামোছার কাজ করেন। এই কবরের পাশে আরেকটি কবরের জায়গা। এখানেই তাঁর কবর হওয়ার কথা। টিনের চালের চার পাশে মাটির বেড়া তিন-চার ফুট উঁচু, তার ওপর বেতের জালি। বাইরের সঙ্গে ভেতরটাকে সংযোগ করে দেওয়া। ঘরটা দেখে কবরখানাও মনে হয় না, আবার থাকার ঘরও নয়। এই ঘরের সামনে বসে আমার ক্যামেরার সামনে আবদুল করিম বলেছেন, ‘আমি নারীভক্ত মানুষ, নারীরা মায়ের জাত। এই সরলা আমার জীবনে না এলে আমি কোনো দিন এই করিম হতে পারতাম না। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস আমি বাড়িছাড়া। দুই দিনের জন্য গান গাইতে গেছি, দুই মাসও হয়তো আসি নাই। ঘরে খাবার নাই, সে কেমন করে সংসার চালাইছে, আমি জানি না।’ এ কথা বলে হু হু করে কাঁদতে শুরু করেন আবদুল করিম।
সরলার প্রসঙ্গে রুহী ঠাকুরকে জিজ্ঞেস করেছিলাম ২০০৪ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর। তিনি বলেছিলেন, ‘ময়মুরব্বির কাছে শুনেছি, তবে বিয়েটা অল্প দিনের ছিল। কিছুদিনের মধ্যে আবার বিয়েটা ভেঙে যায়। আবার এ-ও শুনেছি, আফতাবুন নেসা নামের একজন মহিলা ছিল। ওনার সাথে তার ভাবের সম্পর্ক ছিল।’
আমাদের আলোচনা জমে যায়। চা আসে, বিস্কুট আসে। নুর জালাল অনেকটা জড়তা কাটিয়েছেন। তিনিও প্রাণ খুলে যুক্ত হয়েছেন আলোচনায়। বললেন, ‘বাবার আগের বিয়ে যেহেতু তিনি নিজে অস্বীকার করেছেন, তাই বিষয়টা আমি মেনে নিয়েছি। তবে মনের মধ্যে আমার খানিকটা “সংকোচতা” রয়েই গিয়েছিল, আজ অনেকটা পরিষ্কার হলো মামার কথায়।’
আমি একটু আগ বাড়িয়ে একটা যুক্তি উপস্থাপন করলাম আবদুল করিমের ছেলে নুর জালাল, শ্যালক আফতাব আলী, ভাগিনা আর দু-একজন পাড়া-প্রতিবেশীর সামনে। আমি বললাম, আপনাদের সব কথা শুনে আমার মধ্যে নতুন একটা কথা মনে হলো। আমার মনে হয়, আমার যুক্তিটাই ঠিক।
আমি বলি, করিম সাহেবের জীবনে প্রথম যে নারী এসেছিলেন, তিনিই আফতাবুন নেসা। পরে যে নারী তাঁর স্ত্রী হয়ে আসেন, তাঁর নাম যা-ই হোক, তাঁকে তিনি তাঁর সেই নারীই ভেবেছেন মনেপ্রাণে। তাঁর মনে হয়েছে, পরের নারীই সেই আগের নারী। তাঁকে সেই পুরোনো নামেই তিনি ডাকা শুরু করেন। ‘বৈশাখী ছিল তার মার দেওয়া নাম, সরলা খাতুন নাম আমি রাখলাম’—এ কথা যাঁকে নিয়ে লিখেছেন, তাঁরা দুই নামে একই নারী, কিংবা একই নামে দুই নারী।
এবার মুচকি করে হাসলেন নুর জালাল। মনে হলো, আমার এই যুক্তি তাঁর মনে ধরেছে।

Comments

Popular posts from this blog

আমাজান এর জঙ্গল----Amazon jungle

গ্রামের বাড়ি