অবিকল সুন্দরবন



শ্বাসমূলের ফাঁকে ফাঁকে পা দিয়ে চলতে হয়শ্বাসমূলের ফাঁকে ফাঁকে পা দিয়ে চলতে হয়
দক্ষিণাঞ্চলের যেকোনো জেলায় ভ্রমণের সুযোগ এলে মন ছটফট করে ওঠে। আঁকাবাঁকা নদ-নদী। গাছের সারি। ঘাটে ঘাটে হরেক রকমের মাছ। এর সঙ্গে যদি সংবাদ সংগ্রহের কাজ যোগ হয়, তাহলে তো কথাই নেই। নভেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে এমনই কাজে গিয়েছিলাম বরিশাল ও পটুয়াখালী জেলায়। টানা দুই দিন কাজ করার পর আমাদের প্রথম আলোর প্রধান ফটোসাংবাদিক জিয়া ইসলাম বললেন সময় বের করতে পারলে কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকতের দিকে একটু ঘুরে আসতে। সঙ্গে ছিলেন আমাদের আরেক ফটোসাংবাদিক আশরাফুল আলম। কুয়াকাটায় চলার পথে আমাদের সঙ্গে যোগ দেন প্রথম আলোর পটুয়াখালী প্রতিনিধি শংকর দাশ ও কলাপাড়া প্রতিনিধি নেসারউদ্দিন আহমেদ। চারজনের কুয়াকাটায় যেতে যেতে ঘড়ির কাঁটায় সময় হয়ে এল বেলা দুইটা। পেটে প্রচণ্ড খিদে। হোটেলে বসে খাচ্ছি আর আলোচনা করছি—কী করা যায়। আশরাফের তাগিদ ছিল ছবি তোলার। কথার ফাঁকে শংকর বললেন, চলেন ফাতরার বনে যাই। দেখতে অবিকল সুন্দরবনের মতো।’
ফাতরার বন আগে সুন্দরবনের অংশই ছিল। ছবি: আশরাফুল আলমঝটপট ব্যবস্থা হলো। কুয়াকাটা থেকে দুটি মোটরসাইকেল নিয়ে আমরা চলে গেছি আন্ধারমানিক নদের তীরে, বঙ্গোপসাগরের মোহনায়। যাওয়ার পথে একপাশে ছিল সাগর, অন্য পাশে চোখে পড়ে শুঁটকিপল্লি। আন্ধারমানিকের কূলে এসে দেখলাম, দূরে সারি সারি গাছ। নদে প্রচণ্ড ঢেউ। ভাটার শেষ, জোয়ার শুরু হয়ে গেছে। উজ্জ্বল নীল আকাশ। সূর্যের আলো সবুজ গাছ আর সাগর-নদের জলরাশিকে আরও রাঙিয়ে দিচ্ছে। সুন্দরবনের মতো বনই দেখতে পেলাম। আমার মন তখন উল্লসিত। আন্ধারমানিকের পাড়ে দেখতে পেলাম বন বিভাগের বিট কর্মকর্তা জাফর উল্লাহ আমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন। তাঁর সঙ্গে দুজন প্রহরী আর একটি ছোট ডিঙি। অবশ্য ইঞ্জিন বসানো আছে নৌকাটির সঙ্গে। ওপারেই ফাতরার বন। তবে এপার-ওপারের মাঝে আন্ধারমানিক নদ নয়, আছে খাপড়াভাঙা নদী। এক নদ, এক নদী আর সাগরের মোহনার বুকে ফাতরার বন। এই বন থেকে শুরু হয়েছে বরগুনা জেলা।
বনে যেতে হবে নৌকায় করে। ছোট নৌকায় প্রমত্ত আন্ধারমানিক-খাপড়াভাঙা পাড়ি দিতে হবে—ভাবতেই কাঁপন ধরে যায়। তবে বনের রূপের টানে না যাওয়াটাও সায় দেয়নি আমাকে। আমরা সাতজন প্রমত্ত নদ-নদী পাড়ি দিয়ে ঢুকলাম ফাতরার বনে। বনের যতই কাছে যাই, অবাক হওয়ার মাত্রা ততটাই বাড়তে থাকে। সুন্দরী, গরান, বাইন, গোলপাতা, পশুর, গেওয়া, করমচা—কী নেই? সুন্দরবনের সব গাছ ডালপালা মেলে আছে ফাতরার বনের চারপাশে। ছোট ছোট খাল বনের বুকটাকে চিড়ে দিয়ে গেছে। মাছ ধরার নৌকা থেকে জেলেরাও জাল ছড়িয়ে রেখেছেন সেখানে। নানা প্রজাতির চিংড়ি, পোয়া, তপসে, কোরাল, পারশে, রূপচাঁদা ও ইলিশ মাছের স্বাদ এখান থেকেই মেলে। আর সুস্বাদু কাঁকড়া তো আছেই। বনের ভেতরে যেতে হলে সুন্দরবনের মতো শ্বাসমূলের (হুল) ফাঁকে ফাঁকে পা দিয়ে চলতে হয়। খানিকটা দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে আমরা সবাই গেলাম ফাতরার বনে পশ্চিম-দক্ষিণ প্রান্তে; যেখানে সাগরের সঙ্গে মিশে একাকার হয়ে গেছে আন্ধারমানিক নদ আর খাপড়াভাঙা নদী। মোহনার পাড়ে দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই শুদ্ধ বাতাস, আছড়ে পড়া ঢেউ পা দুটি ভিজিয়ে দিতে লাগল বিরামহীনভাবে। সূর্য যতই সন্ধ্যাবেলাকে কাছে টানছে, জোয়ারের পানি ততটাই বাড়ছিল। এই মোহনায় বিট কর্মকর্তা জাফর উল্লাহ আর শংকর দা বললেন, ফাতরার বন আসলে সুন্দরবনের একটি অংশ ছিল। মানুষের চাপ-প্রতাপে বন থেকে বেঙ্গল টাইগার-হরিণ হারিয়ে গেছে। তবে বানর, শূকর, শজারু, মেছো বাঘ, শিয়াল, অজগরসহ সব ধরনের সাপ, বনমোরগের বসতি আছে এখানে।
.জাফর উল্লাহ জানালেন, বেষ্টনী দিয়ে বনটি সংরক্ষণ করা যেতে পারে। রাখা যেতে পারে বেঙ্গল টাইগার আর হরিণ। জাফর উল্লাহর ইচ্ছা পূরণ হলে হয়তো হারানো সুন্দরবন পূর্ণতা ফিরে পেতে পারে।
কুয়াকাটা ভ্রমণে গেলে পর্যটকেরা সহজেই ঘুরে আসতে পারেন ফাতরার বন। ট্রলার ভাড়া করে যেতে ঘণ্টা দুয়েক সময় লাগে। বন বিভাগের কাছ থেকে অনুমোদন নিয়ে বনভোজনের ব্যবস্থা আছে। বনের ভেতরে ‘মায়ের দোয়া’ নামে একটি ছোট খাবারের হোটেল রয়েছে, যেখানে পাওয়া যায় কাঁকড়া ভাজা, মাছ-চিংড়ি ভাজা। বনের ভেতরে মজাদার খাবার খেতে ভয় নেই। কারণ বাঘ তো হারিয়ে গেছে ফাতরার বনে। তবে বাঘ ফিরে আসুক এখানে, সেটা সবারই প্রত্যাশা। তাহলে বাঘের ভয়ে রক্ষা পাবে ফাতরার বন।
যেভাবে যাবেন
ফাতরার চরে যেতে হলে প্রথমে আসতে হবে কুয়াকাটায়। সেখান থেকে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় এক ঘণ্টায় যাওয়া যায় ফাতরার চরে। ঢাকা থেকে কুয়াকাটায় সড়ক ও নৌ—দুই পথেই যেতে পারবেন। তবে লঞ্চ আসে পটুয়াখালী পর্যন্ত। লঞ্চে সিঙ্গেল কেবিনের ভাড়া ১ হাজার টাকা, ডবল কেবিনের ভাড়া ১ হাজার ৮০০ টাকা ও ভিআইপি কেবিন ভাড়া ৫ হাজার টাকা। পটুয়াখালী থেকে বাস অথবা মাইক্রোবাসে যাওয়া যাবে কুয়াকাটায়। বাসভাড়া জনপ্রতি ১০০ টাকা। মাইক্রোবাসের ভাড়া দরদাম করে নিতে হবে।
ঢাকা থেকে কুয়াকাটায় বাসে যাওয়া যায়। চেয়ারকোচে জনপ্রতি ভাড়া ৬৫০ টাকা। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কনক পরিবহনের ভাড়া ১ হাজার ৩০০ টাকা। কুয়াকাটা থেকে ফাতরার চরে যাওয়ার জন্য ইঞ্জিনচালিত বোট ২ হাজার থেকে ২ হাজার ৫০০ টাকায় পাওয়া যায়। ফাতরার চরে যাওয়ার আগে বন বিভাগ থেকে অনুমতি নিতে হবে।

Comments

Popular posts from this blog

আমাজান এর জঙ্গল----Amazon jungle

গ্রামের বাড়ি