জার্মানিতে ৪০ বছর: পুরনো বন্ধুদের নতুন করে চেনা

সকালে উঠে নুরু ভাই নিজেই আমাদের নাস্তা আর চা খাওয়ালেন। ওই সময়ের জন্য তিনি হয়ে গেলেন আমাদের অভিভাবক। নাস্তা শেষ করার পর নুরু ভাই জানালেন, আমাদেরই আরেক স্কুলের বন্ধু ফরহাদের কাছে নিয়ে যেতে চান।


ফরহাদ হচ্ছে রশিদ, নিলু ও আমার বাল্যবন্ধু। ক্লাস থ্রি থেকে হাই স্কুল পর্যন্ত আমরা একসাথে পড়েছি। ফরহাদ ছোটবেলায় আমার খুবই ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল। কিন্তু কলেজ জীবনে ফরহাদ ছাত্রলীগের দিকে ঝুঁকে পড়ায়, আর রশিদ ও আমি ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী হয়ে ওঠায় আমাদের মধ্যে বন্ধুত্বের দূরত্ব বেড়েছিল। তাই ওর বাসার দিকে যাওয়ার সময় সংকোচ হচ্ছিল। কিছু না জানিয়ে ওর ওখানে গেলে কেমন প্রতিক্রিয়া হবে সেটা ভাবছিলাম?
আমরা তখন জার্মানিতে একেবারেই ভাসমান। তাই যেখানেই আশার আলোর সম্ভাবনা থাকবে সেখানেই আমাদের যেতে হবে। মজার বিষয় হলো, নুরু আর ফরহাদ আমাদের প্রায় ছয় মাস আগে ফ্রাঙ্কফুর্টে গেছে। যদিও তারা দু’জনই ছাত্রলীগের জগন্নাথ কলেজ শাখার নেতৃস্থানীয় ছিল এবং সব সময় একসাথেই চলাফেরা করতো, তবুও ওদের মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ লেগেই থাকতো।
আমরা ফরহাদের ওখানে যখন গেলাম, তখন ওদের মধ্যে মুখ দেখাদেখি নাই। সে কারণে ওই সময় নুরু খুব নিঃসঙ্গ ছিল। নুরু চাইত আবার যেন ফরহাদের সাথে তার মিল হয়।
আমাদের যাওয়াতে নুরু ভেবেছিল, এবার বুঝি আমাদের মাধ্যমে সে পুরনো বন্ধু ফরহাদের সাথে আবার মিলতে পারবে। তবে সে আমাদেরকে জানিয়ে দিল, সে আমাদেরকে ফরহাদের বাসা ও কলিং বেল দেখিয়ে দেবে কিন্তু ঘরে ঢুকবে না।
কী আর করা, অভিভাবক যা বলবেন সেটাই আমাদের মানতে হবে! যতদূর মনে পড়ে, ফরহাদ ফ্রাঙ্কফুর্টের মেইন স্টেশনের কাছাকাছি স্লোসেন স্ট্রিটের ৪ নম্বর বাসায় থাকত। আর নুরুর বাসাটি ছিল ফ্রাঙ্কফুর্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছাকাছি। তার মানে মেইন স্টেশনের দু’দিকে দুটো বাসা,দূরত্ব হবে প্রায় দেড়-দুই কিলোমিটার।
আমরা পাঁচজন হেঁটেই রওনা দিলাম। মস্কোর দুই ডিগ্রির ধাক্কা তো ইতোমধ্যে খেয়েই এসেছি, তাই ফ্রাঙ্কফুর্টের ওই সময়ের তাপমাত্রা নমনীয়ই মনে হল। তখন তাপমাত্রা ছিল ৯ -১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। কিন্তু তাহলে কী হবে,আমরা তো গরমের দেশ থেকে এসেছি,তাই আমরা যার যার শীতের পোষাক পরে নিলাম।
আমি বাহাদুর শাহ্‌ পার্কের কাছে পুরনো কাপড়ের দোকান থেকে কেনা দশ টাকার ওভারকোটটি গায়ে চাপিয়ে নিলাম। ফ্রাঙ্কফুর্ট বা ইউরোপের কোন রাস্তায় আমাদের চারজনের এটাই হলো প্রথম হাঁটা।
হাঁটতে যেয়ে চোখে পড়ছিল ঝকঝকে মসৃণ রাস্তা। জীবনে এই প্রথম দেখলাম সুন্দর রঙের ট্রামগুলো লাইনের উপর দিয়ে চলছে,গাড়িগুলো সব ট্রাফিক আইন মেনে চলছে। এসব দেখে তখন মনে হয়েছিল, একটি স্বপ্নের দেশে এসে বাস্তব চিত্র দেখছি।
প্রায় ৪০ মিনিটের মত হেঁটে আমরা ফরহাদের বাসার সামনে পৌঁছে গেলাম। নুরু এবার দেখিয়ে দিল ফরহাদের কলিংবেল। আমাদের মধ্যে একজন বেল চাপলো। উপর থেকে দরজা খুলে দেওয়া হল। এটাও আমাদের জীবনের প্রথম অভিজ্ঞতা যে উপর থেকে চাপ দিলে নিচের দরজা খুলে যায়।

আমরা চলে গেলাম উপরে ফরহাদের এক রুমের অ্যাপার্টমেন্টে। আমি তো তখন বিনা নোটিশে ওখানে যাওয়ার কারণে লজ্জা আর সংকোচের কারণে বেশ জড়সড় ছিলাম। কিন্তু ওর ওখানে ঢুকেই পেলাম চমক! এতগুলো মানুষকে একসাথে দেখে ও আমাদের পুরনো বন্ধুর মতই হাসি দিয়ে স্বাগত জানালো। আমার তখন মনে হল আমি যেন জ্বরের পর ঘাম ছেড়ে বাঁচলাম।
আমি সারা জীবনই চেষ্টা করে আসছি কোন বন্ধু বা পরিচিতজন যেন আমার জন্য বিব্রতকর পরিস্থিতির সম্মুখীন না হয়। ফরহাদের ওখানে পেলাম নারায়ণগঞ্জের নিজামকে, যে ছাত্রলীগের একজন কর্মী এবং এক মাস আগে জার্মানিতে এসেছে।
ফরহাদ আমাদের কুশল বার্তা জিজ্ঞেসের ফাঁকে ফাঁকে জানাল যে নিজাম এসেই দেশে ফিরে যাওয়ার জন্য কান্নাকাটি করেছে। তবে ফরহাদের বোঝানোতে সে তার ফেরত টিকেট কনফার্ম করতে পারেনি।
নিজাম ১৯৭৭ সালে দেশে ফিরতে চেয়েছিল, তার আর ফেরা হয়নি। আর ফরহাদ ১৯৮৩ -৮৪ সালের দিকে দেশে ফিরে গেছে। মনে পড়ে যায়, সেই স্লোসেন স্ট্রিটের ৪ নম্বর থেকেই শুরু হয়েছিল আমাদের পরবর্তী পদক্ষেপের পরিকল্পনা।

Comments

Popular posts from this blog

আমাজান এর জঙ্গল----Amazon jungle

গ্রামের বাড়ি