ছোটবেলার রসগোল্লা


স্কুলে থাকতে সৈয়দ মুজতবা আলীর একটি লেখা পড়েছিলাম। নাম রসগোল্লা। 
গল্পের বিষয়বস্তু ইউরোপীয় এক এয়ারপোর্টের কাস্ট পুলিশের রসগোল্লা চিনতে না পারা এবং গল্পের নায়ক ঝান্ডুদার প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব ও ব্যপক রসবোধ। ঝান্ডুদা সারাজীবনের জন্য আমার মগজে গেঁথে গিয়েছিলেন, বিশেষ করে তাঁর চামড়ার ব্যাগটার কারণে। সেটায় নানান দেশের, নানান এয়ারপোর্টের আগমন ও বহির্গমনের টিকেট সাঁটা যা প্রমাণ করে ঝান্ডুদা কত অহরহ বিদেশ ভ্রমন করেন। 
সৈয়দ মুজতবা আলী ঝান্ডুদাকে বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন যে, তাঁকে দেখে বোঝার উপায় নেই তিনি দেশে ফিরছেন না দেশের বাইরে যাচ্ছেন। তখন থেকে বড় হয়ে ঝান্ডুদার মত দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়াবো এরকম স্বপ্ন দেখেছি শুধু। মাঝে মাঝে সৈয়দ মুজতবা আলীকেই মনে হত ঝান্ডুদা। ইচ্ছে হত তাঁর মত পনেরটা ভাষা জানবো। মনে মনে নজরুলের কবিতা আওড়াই, “থাকবোনাকো বদ্ধ ঘরে, দেখবো এবার জগৎটাকে, কেমন করে ঘুরছে মানুষ, যুগান্তরের ঘূর্ণিপাকে।” অবশেষে আমার প্রথম বাংলাদেশের সীমানা পার হবার সুযোগ ঘটে ১৯৮৪ সালে। তখন আমার বয়স মাত্র দশ। সেই গল্প আরেকদিন বলবো। আজকের গল্পের সময় কাল ২০১০ সালের এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহ। ভাইকিং লাইনের একটি জাহাজে চড়ে বাল্টিক সাগর পাড়ি দিয়ে যাচ্ছি ফিনল্যান্ডের রাজধানী হেলসিংকি থেকে সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমে। এটা এক রাতের একটি ভ্রমন। সেই ভ্রমনে ফরাসী এক কৃষ্ণাঙ্গ তরুনের সাথে কাটানো কিছু সময় নিয়ে এই গল্প।

ভাইকিং লাইনের সাত তলা বিশিষ্ট জাহাজের সবচেয়ে উপরের তলায় রেস্তোঁরায় বসে রাতের খাবার হিসেবে রেড ওয়াইন আর সালাদ খাচ্ছিলাম। জানালার পাশেই টেবিলটা। খাবারের ফাঁকে ফাঁকে কখনও নোট খাতাটা নাড়াচাড়া করছি, আবার কখনও জানালার স্বচ্ছ কাঁচ দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ঢেউয়ের সাথে ভেসে যাওয়া বরফের টুকরো দেখছি। রেস্তোরাঁর একটি কোনায় বিষাদের গান করছে একটি গানের দল। এমন সময় তরুনটি আমার টেবিলে এসে বললো, “আমি তোমার সাথে বসলে নিশ্চয়ই আপত্তি করবে না!”
সাথে সাথে আমার মাথায় সৈয়দ মুজতবা আলী চাড়া দিয়ে উঠলেন। বিদেশ বিভুঁইয়ে তিনি নতুন নতুন লোকের সাথে আড্ডা দিয়েই ভ্রমন কাহিনী লিখিয়ে হয়েছিলেন। কিন্তু আমি বিদেশ ভ্রমন করতে গিয়ে দেখি- বিশেষ করে ইউরোপে এসে- লোকে অপরিচিতদের সাথে তো কথা বলেই না এমনকি ফিরেও তাকায় না। এমন না যে তারা অমানবিক বা অসামাজিক। সাহায্য চাইলে তারা আন্তরিকভাবেই এগিয়ে আসে কিন্তু ‘প্রাইভেসি’ নিয়ে তাদের জ্ঞান ব্যাপক টনটনে। আর পৃথিবীর আমরা সবাই তো এক ভাষায় কথা বলি না তাই আসলে চাইলেও বিদেশীদের সাথে মন খুলে আলাপ করা যায় না। তো যা বলছিলাম। সৈয়দ মুজতবা আলীর মত একটা দারুণ আড্ডা দেবো এই আশায় আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা কৃষ্ণাঙ্গ তরুনটির দিকে তাকিয়ে সহাস্যে আমার সাথে তাকে বসতে বললাম। কিন্তু মানুষ ভাবে এক আর হয় আরেক।
প্রথমে বলে নিই কিভাবে আমি এই জাহাজে এসে পৌঁছালাম। জানেনতো পৃথিবীতে আজকাল সীমান্ত পারাপার নিয়ে ব্যপক কড়াকড়ি! একদিকে যাদের পাসপোর্ট নেই তাদের জন্য বরাদ্দ রাষ্ট্রের সশস্ত্রবাহিনীর তাড়া, জেল-হাজত আর গুলি, আর অপরদিকে আমাদের – যাদের বাংলাদেশী সবুজ পাসপোর্ট আছে- ভিসা পাওয়ার জন্য পোহাতে হয় অনেক দুর্ভোগ। বিস্তর টাকা পয়সা আর আইনসিদ্ধ দলিলপত্র না থাকলে আপনি নির্বিঘ্নে সীমানা পার হতে পারবেন না। যে সময়টার কথা বলছি তখন আমি এক বছরের একটা বৃত্তি পেয়ে পড়ছি নেদারল্যান্ডে। সেখানকার বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই চেষ্টা তদবির করে আমার জন্য “বসবাসের অনুমতি”-এর ব্যবস্থা করা হয়েছিল। ফলে আমি ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ভুক্ত ২৭ টি দেশেই প্রবেশের অনুমতি পেয়েছিলাম। কিন্তু সেই অনুমতির শর্ত ছিল যে আমি লেখাপড়া ছাড়া আর কোন পেশায় জড়াতে পারবো না। অবশ্য লেখাপড়ার চাপের কথা বিবেচনা করলে আমার পক্ষে অন্য কোন কাজ করা সম্ভবও ছিল না। এই অবস্থায় ঈস্টারের ছুটিতে চার দিনের জন্য ফিনল্যান্ডের রাজধানী হেলসিংকি বেড়াতে গিয়েছিলাম। 
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সহপাঠীর খালা ও মামা থাকেন সেখানে। জাহাজ ভ্রমনের দারুন আইডিয়াটা মামাই দিয়েছিলেন। ফেসবুকে মেসেজ দিয়ে দাওয়াত দেয়ার সময় বলেছিলেন: “আমাদের এখান থেকে জাহাজে চড়ে বাল্টিক সাগর পাড়ি দিয়ে সুইডেনের রাজধানী স্টকহোম যেতে পারবে। সারা রাতের জাহাজ ভ্রমন। জাহাজে আছে ডিস্কো, ক্যাসিনো এরকম নানা পদের বিনোদনের ব্যবস্থা। সকালে স্টকহোম বেড়িয়ে সেখান থেকে উড়োজাহাজে করে আমস্টারডাম চলে যেও।” ৪০ ইউরো খরচ করে আমার জন্য জাহাজের টিকেটও কিনে রেখেছিলেন মামা। এমনকি আমাকে জাহাজে তুলে দিতে তাঁর মেরুণ রঙের গাড়িতে চড়িয়ে সমুদ্র বন্দরে নিয়ে এসেছিলেন। টিকেটের বিল দেখিয়ে কেবিনের চাবি- একই সাথে যেটা জাহাজে উঠার ইলেকট্রনিক পাস- কাউন্টার থেকে বুঝে নিলাম আমরা। কেবিন পর্যন্ত সঙ্গী হয়ে আসলেন মামা। দেখালেন কিভাবে নিজের রুম খুঁজে বের করতে হবে সাত তলা বিশিষ্ট এই জাহাজে। রক্ষে যে প্রতি তলাতেই সিঁড়ির কাছে জাহাজের প্রতি তলার প্ল্যান দেয়া আছে। নির্দেশ করা আছে “আপনি এখন কোথায় আছেন”।
ফ্লোর প্ল্যানের দিকে তাকিয়ে দেখি টাইটানিক জাহাজের মত এটাতেও নীচের ফ্লোরগুলো হল কেবিন। কম দামী থেকে বেশী দামী কেবিনগুলো অপেক্ষাকৃত উপরের ফ্লোরগুলোতে। একদম উপরের ফ্লোরগুলোতে আছে রেস্তোঁরা, ডিস্কো, ক্যাসিনো। বাচ্চাদের খেলার জন্য জায়গা আছে এই জাহাজে, আছে গায়ে গরম জলের ভাপ দেবার ঘর।
পৃথিবীর এই প্রান্তে বছরের এই সময়টায় আবহাওয়াকে জঘন্যই বলা চলে। বরফ পড়া শেষ হয়েছে ঠিকই কিন্তু বেশীর ভাগ সময়ই দেখলাম আকাশটা মেঘলা আর বিষণœ। মাঝে মাঝে ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি আর তার সাথে হীম শীতল ঝড়ো হাওয়া। যানবাহন চলাচলের জন্য রাস্তাঘাট বরফ মুক্ত করা হয়েছে কিন্তু বসতবাড়ি সংলগ্ন বাগান আর কৃত্রিম বনে বরফের স্তুপ। শুনেছি স্ক্যানডিনেভিয়ান দেশগুলোতে রোদের অভাবে নাকি আত্মহত্যার হার খুব বেশী। নিজের চোখে সব দেখে এই সব কানকথা অবিশ্বাস করতে পারলাম না। এতো সুন্দর দেশ। ইচ্ছে করে খোলা চুলে শাড়ীর আঁচল উড়িয়ে পায়ে দুই ফিতার স্যান্ডেল পায়ে ঘুরে বেড়াই। কিন্তু শীতের কারনে ঘরের বাইরে বের হওয়াই মুশকিল। আর বের হলেও আঁটসাঁট জ্যাকেট-জামা-জুতা-মোজা পরতে হয়। এসব কার ভাল লাগে? তবে সাগর পাড়ে গিয়ে আমি সত্যিই অভিভূত হয়ে গেলাম। বরফে ঢাকা সাগর অন্যরকম সুন্দর। 
আমার চির চেনা সে নীলের বদলে সাদা। ঢেউয়ে ঢেউয়ে উত্তাল নয় বরং স্থির এবং কঠিন। সাঁতার কাটার কোন উপায় নেই তার বুকে। তবে বন্দরে গিয়ে দেখি বরফ ভেঙ্গে ঠিকই ভেসে বেড়াচ্ছে বিশাল বিশাল জাহাজ।
জাহাজের কেবিনটা ছোট হলেও এর মধ্যে দুটো দোতালা বিছানা, একটা আলমারি আর ড্রেসিং টেবিল পাতা। কেবিনের ভেতরেই বাথরুম। ছোট্ট ঐ বাথরুমে ঢুকে তো আমি তাজ্জব। আর দশটা দামী হোটেলের মত সেখানে গোসল করার জায়গাটা পর্দা টেনে আলাদা করা, বেসিনের একটা কল দিয়ে গরম পানি আরেকটা দিয়ে ঠান্ডা পানির ব্যবস্থা, বেসিনের পাশে পানি খাওয়ার জন্য বেশ কয়েকটা প্লাস্টিকের গ্লাস , টুথ পেস্ট, টুথ ব্রাশ, ফ্রেশ টাওয়েল, পরিপাটি করে সাজিয়ে রাখা। “ওহ কি দারুন!” ভেবে যেই না আমি কেবিনে ফিরে জানালার পর্দা সরিয়েছি অমনি ফুশ করে আমার সব আনন্দ মাটি হয়ে গেল। ভেবেছিলাম জানালা দিয়ে সাগরের ঢেউ দেখা যাবে। কিন্তু জানালার পর্দা সরিয়ে দেখি কাঁচের জায়গায় নিরেট কাঠের দেয়াল তোলা। কিছুতেই আমি এই বদ্ধ ঘরে থাকবোনা সিদ্ধান্ত নিয়ে, ফ্রেশ হয়ে, কেবিন ছাড়লাম। কেবিনের বাইরে বের হয়েই শুনি স্পীকারে ঘোষণা বাজছে। যদিও সেটা ফিনিশ ভাষায় কিন্তু বুঝতে অসুবিধা হল না এই ডাক জাহাজটির একদম উপরের ফ্লোরে যাবার জন্য, যেখানে আছে সকল আকর্ষণ, আর সেখানেই আমার সাথে ফরাসী নাগরিক সেই তরুনের পরিচয়।
বসতে বলার পরপরই বুঝলাম আমার নতুন এই বন্ধুটি একটু টলছে। তাঁর হাতে একটি বিয়ারের গ্লাস তখনও ছিল। নাম কি, কোন দেশ থেকে এসেছি, কোন উদ্দেশ্যে নিজের দেশ ছেড়েছি এসব প্রশ্ন দিয়েই আলাপ শুরু করি আমরা। বলল ও মায়ের সাথে প্যারিসে থাকে। তার মা ও বাবা সুদান থেকে ফ্রান্সে অভিবাসন করেছিল। উদ্দেশ্য সুদানের অশান্ত অবস্থা থেকে উদ্ধার পাওয়া ও সন্তানদের ভাল স্কুলে পাঠানো। ওর এক ভাইও আছে, সে বেশ কয়েক বছর হল বিয়ে করেছে এবং তাদের একটি সন্তানও আছে। একটু পরেই দেখলাম ওদের। বাচ্চাটিকে বাগিতে চড়িয়ে তারা রেস্তোঁরা থেকে ক্যাসিনোর দিকে চলে গেল। বুঝলাম আমার নতুন বন্ধুটি তার ভাইয়ের পরিবারের সাথে ঈস্টারের ছুটি উপলক্ষ্যে বেড়াচ্ছে। আমার আর ওর ইংরেজীতে কথপোকথনে দক্ষতা খুব বেশী ভাল না। তারপরও আমরা আলাপ চালিয়ে গেলাম। ও প্রশ্ন করলো আমার বয়স কত, বিয়ে হয়েছে কি না। আমি হাসিমুখে মেনে নিলাম যে আমাকে দেখতে সত্যিকার বয়সের তুলনায় অল্পবয়ষ্ক লাগে। আর আঙ্গুলে আঙ্গটি পরা না পরা দিয়ে যে বাংলাদেশের মেয়েদের বৈবাহিক অবস্থা বোঝা যায়না সেটাও বললাম। ব্যাখ্যা করলাম বাংলায় বিবাহিত হিন্দু মেয়েদের সিঁদুর ও মুসলমান মেয়েদের নাক ফুল পরার কথা। আবার দুটোর কোনটাই না পরার বিষয়েও যে আমাদের দেশের লোক উদার সেটাও তাকে বললাম। ও জানালো ওর বয়স ৩০ এবং তার কোন গার্ল ফ্রেন্ডও নেই। এরপর আমাকে সে তার সাথে নাচবার আমন্ত্রণ জানালো। বললো, “জানো, আমি তোমাকে অনেকক্ষণ থেকেই খেয়াল করছিলাম। তোমার সাথে কথা বলার সাহস জোগাড় করতে আমি বেশ কয়েকটা বিয়ার খেয়ে ফেলেছি। এমনিতে আমি পান করি না।” আমি হেসে ওর সাথে নাচতে যেতে রাজী হতেই সে বলল, “আমি একটু টয়লেটে যাবো। কিন্তু আমার ভয় হচ্ছে তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যাবে। তুমি প্লিজ যেও না। আমার তোমাকে ভাল লেগেছে। আমি এখুনি আসছি।” আমি ওকে উত্তর দিলাম, “আমারও তোমাকে ভাল লেগেছে। আমি এই টেবিল ছেড়ে কোত্থাও যাচ্ছি না। তুমি নিশ্চিন্তে ফ্রেশ হয়ে এসো।” 
ইউরোপের তরুণরা কিভাবে মেয়েদের প্রেমের প্রস্তাব করে সে প্রসঙ্গে লন্ডনে অধ্যয়নরত আমার এক বাংলাদেশী পুরুষ বন্ধুর সাথে আমার একটি আলাপের উল্লেখ এখানে না করলেই নয়। সে মন্তব্য করেছিল যে, “আমরা যতই ভাবি না কেন যে ইউরোপীয়রা প্রেম বা সেক্সের ব্যপারে বেশ উদার ও মুক্ত বাস্তবে কিন্তু তারা সেরকম না। তারা এতো হিপোক্রেট যে আকুন্ঠ মদ্য পান করে বেহুঁশ না হওয়া পর্যন্ত অপরিচিত একটি মেয়ের সাথে তারা এসব আলাপ করতেই পারে না।” ফরাসী তরুণটির চলে যাবার দিকে তাকিয়ে আমার এই কথপোকথনটি মনে পড়লো আর আমি আমার খাতাপত্র গুছিয়ে ব্যাগে ঢুকালাম। না পালিয়ে যাবার কোন পরিকল্পনাই আমার নেই। আমার পরিকল্পনা জাহাজটির নাচের ফ্লোরে যাওয়া। খেতে বসার আগে সেটা আমি সরেজমিনে দেখে এসেছিলাম। তখন সেখানে শিশুদের জন্য গান ও নাচ চলছিল। এখন প্রাপ্ত বয়ষ্করা দখল করে নিয়েছে নাচের জায়গাটি। আস্তে আস্তে তাদের ভীড় বাড়ছে সেখানে। শিশুদের ঘুমাতে পাঠানো হয়েছে কেবিনগুলোতে। এখানে বলে নেয়া ভাল যে, মামার সাথে যখন আমি জাহাজে ভ্রমন নিয়ে আলাপ করছিলাম তখন তিনি আমাকে নিশ্চিত করেছিলেন যে জাহাজে মেয়েদের নিরাপত্তার বিষয়টি বেশ কড়া। যেমন, ড্যান্স ফ্লোরে অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটলে ডাকলেই আমি বাউন্সারদের (নাচের ফ্লোরের জন্য নিরাপত্তাকর্মী) সাহায্য পাবো। এমন ভরসা পেয়ে উদ্দাম হয়ে নাচার এই সুযোগ আমি হাতছাড়া করবো তেমন মেয়েই আমি নই। আমি নাচতে খুব ভালোবাসি। তাই বলা ভাল আমি এই সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিলাম। নাচের সঙ্গী হিসেবে একজন তরুণকে পাওয়ায় সুযোগটি একটি নতুন মাত্রা পেল। বাংলাদেশে এভাবে নাচের সুযোগ গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান, দূর্গা পূজার মন্ডপ, আর পাঁচতারা হোটেলেই শুধু পাওয়া যায়।
উপরের কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই তরুণটি ফিরে এলো। হাসি মুখে আমাকে বললো, “আমি ভেবেছিলাম ফিরে এসে তোমাকে আর দেখতে পাবো না। তুমি যে আমাকে ফেলে রেখে চলে যাওনি তার জন্য আমি সম্মানিত বোধ করছি। আমি কি তোমাকে একটা ড্রিংক কিনে দিতে পারি।” আমরা দু’জন হাত ধরে নাচের ফ্লোরের দিকে এগিয়ে গেলাম। ছেলেটির সরলতায় মনে হল ও যে বলেছে ওর বয়স ৩০ তা সত্যি নাও হতে পারে। ড্রিংক কেনার সময় আমি কাউন্টারের একজন পুরুষ কর্মীকে বললাম যে আমি নাচতে যাচ্ছি এবং আমার ব্যাগটি তাদের কাছে গচ্ছিত রাখতে চাই। সে মহানন্দে আমার ব্যাগটি কাউন্টারের এক কোনায় রেখে দিল আর আমাকে উপহার দিল একগাল হাসি আর চোখ টিপি। চোখটিপির অর্থ বাংলাদেশ আর ইউরোপে এক না। ইউরোপে সাধারণতঃ এটা বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ হিসেবেই ধরা হয় অতএব আমি নিশ্চিন্ত মনে আমার ফরাসী বন্ধুর সাথে এগিয়ে গেলাম। ড্রিংক কেনার সময়ই আমার বন্ধুর পরিবারের লোকজনের সাথে আমার আবার দেখা হল তবে তাঁরা দূর থেকেই হাত নেড়ে, উল্লাস ধ্বনি করে আমাদের নাচে যোগ দিতে উৎসাহ দিল।
নাচানাচি করে প্রায় আধঘন্টা পরে ক্লান্ত হয়ে আমরা আবার একটা টেবিলে ফেরত আসলাম। টেবিলগুলোতে এখন আলো আগের চেয়ে অনেক বেশী কোমল। ঘুমাতে যাবার সময় হয়ে এসেছে, ডি.জে বাজাচ্ছে শান্ত আর রোমান্টিক একটি সুর। আশে পাশের টেবিলগুলোতে যুগলরা ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে আছে। আমার বন্ধুটি আমাদের জন্য আরেকটি ড্রিংক নিয়ে আমার কাছকাছি এসে বসলো এবং বলল, “আমি কি তোমাকে একটি চুমু খেতে পারি? তুমি চাইলে আমরা আমাদের ঘরে যেতে পারি। আমার নিজের একটি আলাদা কেবিন আছে। সেটাতে যদি তোমার আপত্তি থাকে আমরা না হয় তোমার কেবিনে যাই।” সৈয়দ মুজতবা আলী কি এরকম কোন প্রস্তাবের মুখোমুখি হয়েছিলেন? কোন গল্পে তো এরকম পড়িনি- মনে মনে এসব ভাবছিলাম আমি, কিন্তু মুখে হাসি ধরে রেখে উত্তর দিলাম, “না আমি সেটা চাই না। আমার তোমাকে অনেক ভাল লেগেছে। অনেক ভাল নাচো তুমি। কিন্তু আমি তোমার সাথে ঘুমাতে যাবো না।” আমার উত্তরে ও ভাবলো আমি যৌন রোগ সংক্রমনের ভয়ে ওকে মানা করেছি। বললো, “তুমি ভয় পেয়ো না। আমার কাছে কনডম আছে।” এ কথা শুনে আমার পেট ফেটে হাসি পেল। বোধহয় একটু জোরেই হেসে ফেলেছিলাম কারণ দেখলাম সামনের টেবিলে বসা একটি যুগলের মধ্যে মেয়েটি ঘুরে আমার দিকে তাকালো। আমার সাথে চোখাচোখি হতেই মুচকি হেসে সে ঘাড় ঘুরালো। আমার বন্ধু ভাবলো আমি ওকে বিশ্বাস করছি না। তাই “এই দেখো” বলেই পকেট থেকে ওর ওয়ালেট বের করে আমাকে খুলে ভেতরের জিনিষপত্র দেখালো। আমার হাতে একটা কার্ড দিয়ে বললো, “আর এটা হল আমার নাগরিকত্বের সার্টিফিকেট। আমি যে সত্যিই ফ্রান্সের নাগরিক এটা তার প্রমাণ।” তৃতীয় বিশ্ব থেকে ইউরোপে অভিবাসন করা একজনের জন্য যে কত গুরুত্বপূর্ণ এই কার্ড সেটা আমি বাংলাদেশী হিসেবে ভালই জানি। কার্ডটা হাতে নিয়ে উল্টে পাল্টে দেখলাম এবং বললাম, “তোমার বয়স মাত্র ২৩! আর তুমি বলেছো তোমার বয়স ৩০!!” এরপর আমরা দু’জনেই হাসিতে ফেটে পড়লাম। আমার বন্ধুটি হাসতে হাসতে বললো, “আমার সত্যিকারের বয়স বললে তুমি আমাকে পাত্তাই দিতে না। ভাবতে আমি বাচ্চা। আমাকে সবাই বাচ্চা ভাবে। আমার কোন গার্ল ফ্রেন্ড হয় না।” আমিও হাসতে হাসতে বললাম, “আমার তোমার আচার আচরণেই ধারণা হয়েছে যে তুমি একটা বাচ্চা।”
আমার কেবিনে ফেরার সময় হয়। আমার বন্ধুটি বলল সে আমাকে লিফ্্ট পর্যন্ত এগিয়ে দিতে চায়। কাউন্টার থেকে আমার ব্যাগটি সংগ্রহ করে আমরা লিফ্্ট পর্যন্ত একসাথে আসি। ও বলে, “আমি কৃষ্ণাঙ্গ সে জন্যই কি তুমি আমাকে প্রত্যাখ্যান করলে?” আমি বললাম, “একদম না। তুমি সুন্দর। কিন্তু কাল সকালে আমার অনেক ঘোরাঘুরি করতে হবে। প্লেন ধরতে হবে। আমি ক্লান্ত।” বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে বিদায় বেলায় চুমু খাবার রেওয়াজ নেই কিন্তু ফ্রান্সে আছে। জানি না সুদানের সংস্কৃতি কি রকম। আমার বন্ধুটি ফরাসী কায়দাতেই বিদায় নিতে চাইলো। আমাকে নিশ্চিন্ত করলো চুমুটি হবে বন্ধুত্বপূর্ণ আর সে আমাকে আর অনুসরণ করবে না। ওর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে কেবিনে ফিরতে ফিরতে স্মরণ করলাম সৈয়দ সাহেবকে। সালাম মঁসিয়ে।

Comments

Popular posts from this blog

আমাজান এর জঙ্গল----Amazon jungle

গ্রামের বাড়ি