দার্জিলিং ভ্রমন , হোটেল ও খরচ


নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা। কল্পনা নয় সত্যি। এখানে মেঘ দেখা যায়, ছোঁয়া যায়। এজন্য প্রয়োজন হয় না পাখির মতো ডানা থাকা কিংবা উড়োজাহাজে চড়ে ঘুরে বেড়ানোর। শুধু প্রয়োজন কর্ম ব্যস্ততার মধ্যে একটু সময় বের করে স্বদিচ্ছার বহিঃপ্রকাশ ঘটানো। তবেই হারিয়ে যাওয়া যাবে বাস্তবের মেঘের দেশে। খুব কাছ থেকে অনুভব করা যাবে মেঘের উষ্ণতা। দেখা যাবে মেঘের লুকোচুরি খেলা। এই খেলায় মেতে ছিলাম আমরা কয়েকজন। ইচ্ছে হলে দূর্গা পুজোর এই লন্বা ছুটিতে আপনিও ঘুরে আসতে পারেন শিলিগুড়ি ও শৈলশহর দার্জিলিং।

যাত্রা শুরু হলো শিলিগুড়ির উদ্দেশ্যে। সন্ধ্যে ৬ টায় আমরা পৌঁছে গেলাম এয়ার ভিউ মোড়ে। পরের দিন সকালে নাস্তার টেবিলে মিনি মিটিংয়ের সারসংক্ষেপ হচ্ছে দার্জিলিং যাওয়া। এয়ার ভিউ থেকে অটোতে চড়ে সোজা মালাগুড়ি মোড়। এখানেই হোটেলের সামনে থেকে খুব সহজেই দার্জিলিং যাওয়ার গাড়ি পাওয়া যায়। সিঙ্গেল ২০০-২৫০ টাকা, রিজার্ভ ৭০০-৮০০ টাকা। আমরা এবার দার্জিলিংয়ের পথে। 

উঁচু পাহাড়ের কোল ঘেষে সরু রাস্তা বেয়ে আমরা যেন শুধু উপরেই উঠছি। কি পরিমান উপরে আছি তা নিচে তাকালে বোঝা মুশকিল। এমনকি ভয়ে আৎকে উঠতে পারেন। তাই দার্জিলিং যাওয়ার পথে নীচে না তাকানোই ভালো। তবে নীচে তাকানোর মুহূর্ত পাল্টে দেবে চা বাগানের সবুজ দৃশ্য। দেখে মনে হবে বাগান নয় যেন সমুদ্রের নীল ঢেউ আর নীলাকাশে সাদা মেঘ। মেঘের কণা উড়াউড়ি করছে। 

স্পর্শ করছে আপনার হাত। এমনই এক মনোমুগ্ধকর জার্নি শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিংয়ের পথ। সাড়ে তিন ঘণ্টা কীভাবে পার হলো টেরই পেলাম না। গাড়ি পৌঁছালো শৈলশহর দার্জিলিংয়ের হোটেলের সামনে। গাড়ি থেকে নামতেই ধূসর গুঁড়ি গুঁড়ি শিশির বিন্দুর মতো শরীর স্পর্শ করছে। এবার হোটেলে বিশ্রামের পালা। 

টাইগার হিল



দার্জিলিংয়ে দ্বিতীয় দিন থেকে উদ্দেশ্য দর্শনীয় স্থানগুলো ঘুরে দেখা। হোটেল বয় এর মাধ্যমে ফোর হুইলার জীপ গাড়ি সংগ্রহ হয়েছে। এবার যাচ্ছি অন্যতম আকর্ষনীয় স্থান টাইগার হিল। এটি দার্জিলিংয়ের সবচেয়ে উঁচু স্থান। সাগর থেকে সাড়ে ৯ হাজার ফিট উপরে। ভারতের একমাত্র এই স্থান থেকে সূর্য উদয় দেখা যায়। বিভিন্ন দেশের পর্যটকরা এখানে আসেন সানরাইজ দেখার জন্য। 

এ জন্য আপনাকে ৪টা ৪৫ মিনিটের আগে যেতে হবে টাইগার হিলে। তবেই দেখা মিলবে সাত রঙে রাঙ্গা সূর্য। এই দৃশ্য আরো সুন্দর হওয়ার কারণ হচ্ছে সূর্য উদয় হওয়ার পর এটি কাঞ্চন জড়ঘার ওপর প্রভাব ফেলে। তখন দেখা যায় কাঞ্চন জড়ঘার অপরূপ সৌন্দর্য। এখানে আরো বাড়তি পাওনা মেঘের লুকোচুরি খেলা। তুলোর মতো ছোট ছোট মেঘের কণা উড়োউড়ি করে আপনাকে স্পর্শ করবে।

বাতাসিয়া লুপ


টাইগার হিল থেকে এবার যাত্রা শুরু হলো বাতাসিয়া লুপ। তখন ঘড়ির কাঁটা সকাল সাতের কোঠায়। এখানে রয়েছে পার্ক টয়ট্রেন। বৃটিশ আমলের এই টয়ট্রেনে চড়ে আপনি ঘুরে বেড়াতে পারেন। এখানে রয়েছে ছবি তোলার বিশেষ আয়োজন। বিভিন্ন দেশের পোশাক পড়ে ছবি তুলতে পারেন। এজন্য সঙ্গে ক্যামেরা থাকার প্রয়োজন নেই। ছবি তুলে আপনার অবস্থানকৃত হোটেলে পৌঁছে দেয়ার জন্য রয়েছে অভিজ্ঞ ফটোগ্রাফার। বাতশিয়ালুক ভ্রমন শেষে এবার হোটেলে নাস্তা খাওয়ার পালা। 

ঘুম মনেস্টি


চটজলদি নাস্তা সেরে নিয়ে চলে গেলাম ঘুম মনেস্টি দেখার জন্য। ঘুম মনেস্টি এশিয়ার সবচেয়ে উঁচু রেল স্টেশন। জায়গাটিতে বছরের প্রায় দশমাসই মেঘলা থাকে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অনেক বার এসেছেন ঘুম মনেস্টিতে। গল্প লিখেছেন ঘুম মনেস্টি নিয়ে। তার ভাষায় এলাকাটি ঘুমন্ত ও শান্ত স্থান। এই স্থানের উচ্চতা সাড়ে ৮ হাজার ফিট। 

তেনজিং মিউজিয়াম


ঘুম মনেস্টি দেখা শেষ হলে ঘুরে আসুন তেনজিং মিউজিয়াম। এখানে দেখতে পাবেন তেনজিং শের পা ও এডমন হিলারির এভারেস্টে যাওয়ার সকল সরঞ্জাম ও প্রথম এভারেস্ট জয়ী তেনজিংয়ের মমি। এরপর ঘুরে দেখুন ক্যাবল রোপ ওয়ে।

ক্যাবল রোপ ওয়ে উঠতে আপনাকে ২৫০ টাকা দিয়ে টিকেট সংগ্রহ করতে হবে। এটি দশ কি.মি. লম্বা। ক্যাবল রোপ ওয়ে বসে দার্জিলিংয়ের প্রকৃতিক সৌন্দর্য ছোট ছোট গ্রাম, চা বাগান, লেক, ঝর্না ও মেঘের লুকোচুরি খেলা দেখা যায়। বাড়তি পাওনা সিকিম বর্ডার। আপনার সিকিম যাওয়ার সৌভাগ্য না হলেও ক্যাবল রোপ ওয়ে বসে সিকিম বর্ডার দেখতে পাবেন।

দার্জিলিংয়ে আরো যে সব দর্শনীয় স্থান রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে তেনজিং রক, হ্যাপিভ্যালি টি গার্ডেন, জাপানিজ টেম্পল, লাল কুঠি, কুচবিহার বাজার, রাজবাড়ি ও রং মহল। 



মিরিক


ফিরে আশার পথে নেপাল বর্ডার হয়ে ঘুরে আসুন মিরিক। মিরিকে রয়েছে বিশাল লেক। এই লেকে বড় বড় মাছ এবং কচ্ছপই হচ্ছে ঘুরে দেখার অন্যতম আকর্ষণ। ইচ্ছে হলে খাবার কিনে দিতে পারেন এই জলপ্রাণীকুলকে তবেই তাদের দেখা মিলবে। এখানে আপনি ২০-৫০ টাকার বিনিময় ঘোড়ার পিঠে চড়ে লেক ভ্রমন করতে পারবেন। 

কালিমপং


মিরিক ঘুরে দেখার পরে হাতে বাড়তি সময় থাকলে ঘুরে আসতে পারেন কালিমপং। এটি তিন হাজার ফিট উপরে। কালিমপংয়ে রয়েছে ভেলো পার্ক। ১০ টাকা দিয়ে টিকেট নিয়ে ভেলো পার্ক থেকে কালিমপং ও সিকিমের সুদৃশ্য সিনারি দেখা যায়। রয়েছে প্যারাগ্লইডিং। শিশুদের ২০০০ টাকা ও বড়দের ২৫০০ টাকা বিনিময় পাহাড়ের উপর দিয়ে ট্রেনারের সাথে ২৫ মিনিট ঘুরে দেখার সুযোগ রয়েছে এখানে। কালিমপংয়ে আরো রয়েছে রাম ভক্ত হনুমানের ভাস্কর্য, পাহাড়ি ফুলের বাহারি সব আয়োজনের ফাওয়ার গার্ডেন, হ্যালিটকে পাহাড়ের চূঁড়ায় উঠে ছবি তোলা ও বুদ্ধিস্ট টেম্পল।

কালিমপং থেকে সোজা চলে আসুন শিলিগুড়ি। যদি কোন কিছু কেনাকাটা করার ইচ্ছে থাকে তবে আপনাকে শিলিগুড়ি থেকেই শপিং করতে হবে। কারণ দার্জিলিং ও কালিমপংয়ের চেয়ে তুলনামূলক অনেক কম দামে শিলিগুড়িতে কেনাকাটা করা যায়। এজন্য রয়েছে বিধান মার্কেট, সিটি সেন্টার ও বিগ বাজারসহ বেশ কয়েকটি অত্যাধুনিক শপিংমল।

দার্জিলিংয়ে কেনাকাটা


দার্জিলিং এক স্বর্গ রাজ্যের নাম। সেখানকার পাহাড়ী পরিবেশ, ঠান্ড ঠান্ডা আবহাওয়া আর এই রোদ এই বৃষ্টির খেলা বিমোহিত করে সবাইকে। কিন্তু এখন ঘুরতে যাওয়া কেবল ঘোরা, সুন্দর সুন্দর জায়গায় ছবি তোলা আর খাবার খাওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। বরং সেখানে যুক্ত হয়েছে নতুন একটি শব্দ কেনাকাটা।
দার্জিলিংয়ে গিয়ে ঘোরাফেরা অনেক করলেন এবার না হয় যাবার আগেই জেনে নিন সেখানে কেনাকাটা করার জায়গাগুলোর হদিশ। তাহলে ফিরে এসে আর হাপিত্যেস করে মরতে হবে না। বরং সবার জন্য ব্যাগ ভরে আনতে পারবেন নানান রকমের মজার মজার জিনিস।

কোনো সুভ্যনির বা জিনিস কেনার জন্য অস্থির হয়ে উঠলে অনায়াসে চলে যেতে পারেন চকবাজার। ছোট ছোট দোকান, কিছু চায়ের স্টল আর লাইন ধরে বিক্রি করতে থাকা সবজি অনেক সময় সব ধরনের ভ্রমণপিয়াসুদের আকর্ষণ করে। সবাই এখান থেকে কেনাকাটা করতেও বেশ স্বচ্ছন্দবোধই করে।

টয় ট্রেন বাতাসিয়া লুপে পৌঁছলেই বিক্রেতারা রীতিমতো তোড়জোর শুরু করে দিবে। লাইনের ওপরই বসে থাকবে লম্বা বাজার। সেখান থেকে নিজের মনের মতো কিছু জিনিস বের করে নিতে পারেন। নিয়ে আসতে পারেন সবার জন্য।

আপনি যখন মলরোড ধরে যাবেন, আর অবাক হয়ে দেখবেন সেখানে কি নেই? ছোট ছোট দোকান থেকে বইয়ের দোকান আর সেসব ছাড়িয়ে রেস্টুরেন্ট, ক্যাফে আর টি-স্টলতো আছেই। সবমিলিয়ে সেখানেও বাজারটা নিশ্চয়ই খারাপ হবে না।

Comments

Popular posts from this blog

আমাজান এর জঙ্গল----Amazon jungle

গ্রামের বাড়ি